গত গ্রীষ্মে আফগানিস্তানে তালেবান হামলার সময় হাজারো আফগান নারীদের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন একসময় নিজেই শরণার্থী হয়ে দেশ ত্যাগ করা নাদিয়া নাদিম। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ নারী ফুটবল লিগের ক্লাব রেসিং লুইসভিলের এই তারকা ফুটবলার এবার রাশিয়ার হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ইউক্রেনীয় নারীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার হামলায় এখন পর্যন্ত প্রায় হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিধ্বস্ত হয়েছে ইউক্রেনের শত শত স্থাপনা। লাখ লাখা মানুষ দেশটি ছেড়ে পাশের দেশগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে। তবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অনেক দেশকে শক্ত অবস্থান নিতেও দেখা গেছে। বিশেষ করে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ক্রীড়াবিশ্ব প্রায় এক কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে। অধিকাংশ ক্রীড়া সংস্থা রাশিয়াকে নিষিদ্ধ করেছে কিংবা বয়কট করেছে। যুদ্ধের বিরুদ্ধে বার্তা দিতে খেলার মাঠেও উড়ছে ইউক্রেনের পতাকা। সমর্থকদের কাছ থেকে নিজ দেশের প্রতি এমন সমর্থন দেখে এমনকি কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়েন ম্যানচেস্টার সিটির ইউক্রেনীয় ফুটবলার ওলেকজান্ডার জিনচেঙ্কো। কিন্তু নাদিয়ার ব্যাপারটা একেবারেও অন্যরকম।
শৈশব পেরোনোর আগেই যুদ্ধের প্রভাব পড়েছিল নাদিয়া নাদিমের জীবনে। তার বাবাকে তালেবান যুদ্ধারা হত্যা করার পর পরিবারের বাকি সদস্যদের সঙ্গে দেশ ছাড়তে হয় তাকে। ফলে যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারেন তিনি। তিনি ভালো করেই জানেন, যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন নারী ও শিশুরা। তাই ইউক্রেনীয় নারীদের পাশে দাঁড়াতে কালবিলম্ব করেননি তিনি। 'গোল ডট কম'-কে তিনি জানান, যুদ্ধের বিপক্ষে ক্রীড়াবিশ্বকে একত্রিত হতে দেখে খুব ভালো লাগছে তার। কিন্তু এখনও ক্ষতিগ্রস্তদের অনেক সাহায্য দরকার; যা ভেবে কষ্ট পাচ্ছেন তিনি।
নাদিয়া বলেন, 'আমি জানি (ইউক্রেনের) মানুষজনের অনুভূতি এখন কেমন। কেউই আসলে নিজের পরিবার, বাড়িঘর, পরিচয় সবকিছু ফেলে যেতে চায় না। আমি ছবি দেখে বুঝতে পারি সেখানকার শিশুসহ সবাই কতটা কষ্টে আছে। এটা আমার হৃদয় ভেঙে দিচ্ছে। আমার মতে, এটার (যুদ্ধ) কোনো মানে হয় না। সমস্যা সমাধানের বহু উপায় আছে। নিরাপরাধ মানুষদের হত্যা করা কিছুতেই কোনো সমাধান নয়। শিশু ও নারীরা এই যুদ্ধে সরাসরি জড়িতই নয়। তাদের কিছুই বলার নেই। এসব হৃদয়বিদারক। '
নাদিয়া নাদিম মানবিক ডাকে সাড়া দিতে কখনোই পিছুপা হন না। গত গ্রীষ্মে তালেবান যখন দ্বিতীয়বারের মতো আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করল, তখনও তিনি দেশটির নারীদের সাহায্যার্থে ৯০ হাজার মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ আর্থিক সহায়তা করেছিলেন। আর এবার তিনি কাজ করছেন সামাজিক সংস্থা গেম অব আওয়ার লাইভস (GOL)- এর হয়ে। সংস্থার ইউক্রেন ক্যাম্পেইনের অংশটি গত শুক্রবার থেকে চালু হয়েছে। এর মাধ্যমে মানুষ পণ্য দান করতে পারে কিংবা সরাসরি অর্থ দান করতেও পারে। এছাড়া পিটিশন সাইন করা থেকে শুরু করে শিক্ষাভিত্তিক কাজও করে তারা।
নিজের নতুন ভূমিকা নিয়ে নাদিয়া বলেন, 'আমার মতে এটা দারুণ আইডিয়া। আমি সাহায্য করতে চাই। আমি পরিবর্তন আনতে চাই। এমন একটা প্ল্যাটফর্মে কাজ করতে পারা, যার মাধ্যমে এই উদ্দেশ্য সফল করা সম্ভব; আমার মতে এটা দারুণ ব্যাপার। ' শুরুতে নাদিয়াদের সংস্থাটি নারীদের ক্ষমতায়ন এবং লিঙ্গ সমতা নিয়ে কাজ করছিল। এখন তাদের মূল লক্ষ্য ইউক্রেনের ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের সহায়তা করা। তবে নাদিয়া আরও অনেককিছু করার পরিকল্পনা করে রেখেছেন।
এই আফগান ফুটবলার বলেন, 'অনেক দেশে নারীদের পড়াশোনা করা কিংবা খেলায় অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ। তবে খেলাধুলার মাধ্যমে সুযোগ তৈরি হচ্ছে। আমি মনে করি ফুটবলের অনেক ক্ষমতা। এটা শুধু খেলাই নয়, এটা শিক্ষার একটি উপকরণও বটে। আমি তারুণ্যের সময়টায় নিজ সম্প্রদায়ে এটা করেছি। আমি শুধু ফুটবল খেলে গিয়েছি, পরে মানুষজনের ভাবনায় পরিবর্তন আসে। আমরা যদি এটা বড় পর্যায়ে করতে পারি, যেখানে নারীদের ফুটবল খেলতে দেওয়া হয় না, তাহলে মানুষজনকে ব্যাপারটা শেখাতে পারব। ছেলেদের মতো, ছোট মেয়েদেরও একই সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। '
১৯৮৮ সালে আফগানিস্তানের হেরাত প্রদেশে জন্মগ্রহণ করা নাদিয়া শুধু ফুটবলারই নন, একজন ফিজিশিয়ানও। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তিনি ডেনমার্ক জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন। তবে এজন্য তাকে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। কারণ ১৮ বছর পূর্ণ না হওয়ায় ২০০৬ সালে ডেনমার্কের নাগরিকত্বের আবেদন করেই খালি হাতে ফিরতে হয় তাকে। ২০০৮ সালে আবেদন মঞ্জুর হলেও ডেনমার্ক জাতীয় দলের হয়ে খেলায় বাধা দেয় ফিফা। কারণ ১৮ বছর পার হলেও দেশটিতে আরও পাঁচ বছর বসবাস করতে হতো তাকে। কিন্তু ড্যানিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিইউ) ফিফার সঙ্গে আইনি লড়াই চালিয়ে নাদিয়ার অনুমতি পাইয়ে দেয়। এরপর ডেনমার্ক জাতীয় দলের জার্সিতে নারীদের ২০০৯ ইউরোয় খেলেছেন তিনি। ২০১৩ ইউরোতেও স্কোয়াডে ছিলেন তিনি। ২০১৭ ইউরোয় ডেনমার্কের ফাইনালে উঠার পেছনেও অবদান ছিল তার। ২০০০ ইউরোর বাছাইপর্বে ইতালির বিপক্ষে ডেনমার্কের জয়ে দুই গোল করেছিলেন তিনি। পরের ইউরোয় ডেনমার্কের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছিল তাতেই।
নাদিয়াকে আফগান নারী ফুটবলের সবচেয়ে বড় তারকা বলা হয়। ২০২০-২১ মৌসুমে এই ফরোয়ার্ড পিএসজি নারী দলের হয়ে ফ্রেঞ্চ লিগ জিতেছিলেন। তার বাবা ছিলেন আফগান সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল। ২০০০ সালে তাকে হত্যা করে তালেবান যুদ্ধারা। এরপর দেশ ছেড়ে তার পরিবার পাড়ি জমায় ডেনমার্কে। নতুন দেশে ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করে তড়তড় করে সাফল্যের সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে যান তিনি। ২০১২ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগেও অভিষেক হয় তার। সেবার ড্যানিশ ক্লাব ফরচুনা হজরিং-এর জার্সিতে আসরের ফাইনালে স্কটিশ চ্যাম্পিয়ন গ্লাসগোর বিপক্ষে দলের ২-১ গোলের জয়ে দুটি গোলই করেন তিনি।
২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওমেন্স সকার লিগের দল স্কাই ব্লুতে যোগ দেন নাদিয়া। নতুন ক্লাবের হয়ে ৬ ম্যাচেই ৭ গোল ও ৩ অ্যাসিস্ট করেন তিনি। এমনকি ওই বছরের আগস্টে সপ্তাহের সেরা ও মাসের সেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হন তিনি। পরে আরও এক মৌসুম ওই ক্লাবের হয়েই খেলেন নাদিয়া। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে তিনি যোগ দেন পোর্টল্যান্ড থর্নসে। সেখানে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলে ২০ গোল করে মৌসুমের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন তিনি। তার হাত ধরেই সেবার শিল্ড জিতে নেয় দলটি। পরের মৌসুমে দলটিকে লিগের দ্বিতীয় ও চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচে জয় এনে দেন তিনি। এরপর ২০১৮ সালে ম্যানচেস্টার সিটি, ২০১৯ সালে পিএসজি এবং ২০২১ সালে রেসিং লুইসভিলে পাড়ি জমান তিনি। এখনও এই মার্কিন ক্লাবেই খেলেন নাদিয়া।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪২ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০২২
এমএইচএম