রান্না-বান্না ও ঘর-সংসারের আনুষঙ্গিক কাজ স্ত্রীর জন্য আবশ্যক নয় শরিয়তের দৃষ্টিতে বিয়ে এমন একটি চুক্তি বিশেষ। যাতে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের দায়িত্ব ও অধিকার শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত।
এমনকি স্বামী-স্ত্রী নিজেরাও কোনো কিছুর হেরফের করতে পারবে না, প্রচলিত প্রথাও বৈবাহিক দায়িত্বের কোনো কিছু বাড়াতে-কমাতে পারবে না। কোরআন ও হাদিসের আলোকে সংসার জীবনে স্ত্রীর যেসব দায়িত্ব ও করণীয় অবধারিত প্রমাণিত হয় সেগুলো-
স্বামীর কর্তৃত্ব ও অধীনতা মেনে নেওয়া, স্বামী যে ঘরে তাকে রাখে সেখানে অবস্থান করা, স্বামীর অনুমতি ছাড়া বাইরে না যাওয়া, স্বামীর সন্তান ও সম্পদ রক্ষা করা, নিজের সতীত্ব রক্ষা করা এবং স্বামীর যৌন চাহিদা পূরণ করা।
এর বাইরে আর কোনো কাজ করতে স্বামীর সংসারে স্ত্রী আইনতঃ বাধ্য নয়। অতএব, সংসারের জন্য রান্না-বান্না, ঘর-সংসারের আনুষঙ্গিক কাজ থেকে শুরু করে কোনো গার্হস্থ্য কাজ স্ত্রীর জন্য আবশ্যক নয়।
স্ত্রী যদি এমন পরিবারের মেয়ে হয়ে থাকে যে পরিবারের মেয়েরা বাপের বাড়িতে ঘর-সংসারের কাজ করে না, তাহলে স্বামীর কর্তব্য স্ত্রীর খাবার রান্না করার ব্যবস্থাসহ তার কাপড়-চোপড় ধৌত করার ব্যবস্থা করা। আর যদি স্ত্রী এমন পরিবারের মেয়ে হয়, যে পরিবারের মেয়েরা বাপের বাড়িতে ঘর-সংসারের কাজ নিজ হাতে করে; তাহলে স্ত্রীর ওপর নৈতিক দায়িত্ব এসে যায় নিজের খাবার নিজেই তৈরি করা ও নিজের পোশাক-পরিধেয় নিজেই ধৌত করা।
কিন্তু সেক্ষেত্রেও স্ত্রী যদি রান্না-বান্না করতে বা ঘর-সংসারের কাজ করতে অস্বীকার করে, তাহলে স্বামী তাকে আইনতঃ বাধ্য করতে পারবে না। এই হলো- শরয়ি আইনের কথা। কিন্তু সুষ্ঠু, সুন্দর ও হৃদ্যতাপূর্ণ একটি সংসারের জন্য ইসলামে আইন ছাড়াও রয়েছে আদর্শিক দিক। মূলতঃ ইসলামের অনুসরণীয় ব্যক্তিদের ও মুসলমানদের পারিবারিক জীবনের ঐতিহ্য দাঁড়িয়ে আছে ইসলামের সুদৃঢ় আদর্শিক ভিত্তির ওপর।
আমরা জানি আইন হয় অধিকার আদায়ের জন্য। কেউ যদি তার অধিকার যথাযথভাবে বুঝে নিতে চায়, তবে তার জন্য ইসলামে রয়েছে আইন ও আদালত। কিন্তু কেউ যদি শান্তি সুখ চায়, স্বস্তি ও প্রশান্তির জীবন চায়- তার জন্য রয়েছে ইসলামের পারিবারিক জীবনের আদর্শিক দিক। তাকে আইনের থেকে ঊর্ধ্বে উঠে আদর্শের অনুসারী হতে হবে। সংসার ও দাম্পত্য জীবনের সুখ আইনে রুষ্ঠতায় নয় বরং আদর্শের কোমলতায় নিহীত।
এসব আদর্শের চর্চা হয়েছে নবী করিম সাল্লাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংসারে এবং সাহাবাদের সংসারে। কিন্তু আদর্শিক দিকটি মানতে কেউ বাধ্য নয় এবং অপরকে তা জোর করে মানানোর সুযোগও নেই, এটা একান্তই ঐচ্ছিক।
নবী করিম (সা.)- এর স্ত্রী ও তার নারী সাহাবিদের সবাই কিন্তু নিজেদের সংসারের কাজ নিজেরা করতেন। এমনকি তাদের মধ্যে যাদের ঘরে এক বা একাধিক দাসী ছিল তারাও সংসারের শতভাগ কাজ দাসীদের দ্বারা করাতেন না। বরং নিজেরা কাজে হাত দিতেন। সম্ভবত নবী ও সাহাবিদের পারিবারিক জীবনের এমন একটা বর্ণনাও পাওয়া যাবে না, যাতে প্রমাণিত হবে কোনো একজন নারী সাহাবি স্বামীর ঘরে কোনো কাজই করতেন না। বরং হাদিস গ্রন্থগুলোতে বিশেষত নারী সাহাবিদের জীবনী গ্রন্থগুলোতে বিপরীত বর্ণনাই প্রচুর পাওয়া যায়। সেসব বর্ণনাতে দেখা যায়, মহিলা সাহাবিরা স্বামীর সংসারের কাজগুলো নিজেরাই করতেন। যেমন-
হজরত আলী (রা.) বর্ণনা করেন, জাঁতা দিয়ে গম ভেঙে আটা গুঁড়ো করতে করতে (নবী কন্যা) হজরত ফাতেমা (রা.)-এর হাতে ঠোসা পড়ে গিয়েছিল। তাই তিনি নবী করিম (সা.)- এর কাছে গিয়েছিলেন একজন দাসীর জন্য। বাড়ি যেয়ে যখন বাবাকে পেলেন না, তখন মা হজরত আয়েশা (রা.)-কে সবকিছু জানালেন। হজরত আয়েশা (রা.) নবী করিম (সা.)- এর কাছে হজরত ফাতেমা (রা.)- এর আগমনের সংবাদ পৌঁছে দিলেন। যখন নবীজী বাড়িতে আসলেন তখন মা আয়েশা ও ফাতেমা এক বিছানায় শুয়েছিলেন। যখন নবী করিম (সা.) আসলেন, তখন নবীজীর শব্দ শোনে তারা উঠতে গেলে নবী করিম (সা.) তাদের উঠতে বারণ করলেন। নিজে যেয়ে তাদের মাঝে বসলেন। পরে হজরত ফাতেমাকে (রা.) বললেন, তুমি আমার কাছে যা চাচ্ছো তার চেয়ে আরও ভালো জিনিস আমি তোমাকে দেবো কী? তুমি যখন বিছানায় শোবে তখন ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ বলবে, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ বলবে এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার বলবে। -সহিহ বোখারি: ৩১১৩ ও সহিহ মুসলিম: ৭০৯০
বর্ণিত হাদিসে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, নবী কন্যা হজরত ফাতেমা (রা.)- এর স্বামীর সংসারের কাজকর্ম নিজের হাতেই করতেন। আটা পিষতে পিষতে হাতে দাগও পড়ে গেছে। কিন্তু নবী করিম (সা.) মেয়েকে স্বামীর সংসারের কাজ করতে বারণ করেননি, কিংবা জামাতাকে অভিযুক্ত করেননি। স্বামীকে বলেননি, আমার মেয়েকে দিয়ে কেন করাচ্ছো? তাকে কাজের লোক রেখে দাও ইত্যাদি ইত্যাদি।
বরং অন্য বর্ণনায় পাওয়া যায়, কূপ থেকে খাবার পানি চামড়ার মশকে করে কাঁধে ঝুলিয়ে বহন করতে করতে হজরত ফাতেমা (রা.)- এর ঘাড়ে দাগ পড়ে গিয়েছিল।
পবিত্র কোরআনের সূরা যারিয়াতের ২৬ নম্বর আয়াতে দেখা যাচ্ছে, দুইজন ফেরেশতা যখন মানুষের আকৃতি ধারণ করে হজরত ইবরাহিম (আ.)- এর কাছে এলেন তখন তিনি তাদের চিনতে পারলেন না। তাদের সঙ্গে সালাম ও কুশল বিনিময় করেই তাদের মেহমানদারি করার জন্য কিছু আনতে ছুটে যান স্ত্রীর কাছে।
পবিত্র কোরআনের এ বর্ণনা ধারা থেকে বুঝে আসে, হজরত ইবরাহিম (আ.)- এর স্ত্রীও ঘর-সংসারের কাজ করতেন। তাই তিনি মেহমান বসিয়ে রেখে মেহমানদারির জন্য স্ত্রীর শরণাপন্ন হন।
বর্ণিত আয়াত ও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, ঘর-সংসারের কাজ সাধ্যমতো নিজে করা স্ত্রীদের জন্য নববী সুন্নত; যদিও ফরজ নয়।
এক্ষেত্রে আইন ও আদর্শ এবং ফরজ ও সুন্নতের সমন্বয়টা এভাবে হবে, স্বামী তার স্ত্রীকে সংসারের কোনো কাজ করতে বাধ্য করবে না। সর্বোচ্চ তাকে উৎসাহিত করা যেতে পারে, অনুরোধ করতে পারে। কিন্তু স্ত্রী সংসারের কাজকর্মকে ইবাদত মনে করে সওয়াবের নিয়তে সাধ্যমতো করবে। চেষ্টা করবে নববী আদর্শের অনুসরণ করতে। আর স্ত্রী তার সাধ্য ও ইচ্ছামতো সংসারের যতটুকু কাজ করবে স্বামী এজন্য স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে এবং মুখে ও আচরণে স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।
সংসারের যেসব কাজ স্ত্রীর দ্বারা হবে না বা ত্রুটিপূর্ণ হবে, ভুল হবে সেগুলোর জন্য স্ত্রীকে স্বামী তিরষ্কার করবে না, দোষারোপ করবে না। বরং এক্ষেত্রে স্বামীকে হতে হবে সর্বোচ্চ সহনশীল।
স্বামী বাইরে থেকে ঘরে এসে গার্হস্থ্য কাজে স্ত্রীর সঙ্গে হাত মেলাবে। স্ত্রীর কাজে সহযোগিতা করবে। যেমনটি নবী করিম (সা.) নিজে করতেন।
মনে রাখতে হবে, আইন ও আদালত কিন্তু ঘরের সুখ নিশ্চিত করতে পারে না। এজন্য প্রয়োজন পারস্পরিক মমতাবোধ, শ্রদ্ধাবোধ, দায়িত্বশীলতা, আস্থা, বিশ্বাস, নির্ভরতা, সহানুভূতি, সহনশীলতা, বুদ্ধিমত্তা, বিবেক, অপরের অধিকার দেওয়ার প্রেরণা, নিজের অধিকার ত্যাগ করার মানাসিকতা, একে অপরকে বুঝার আগ্রহ। তাই যুগে যুগে পরিবারের মধ্যে আইনের চর্চা না হয়ে আদর্শের চর্চা হয়েছে। আইন কাজ করবে আদালতের এজলাসে। কিন্তু ঘরে রাজত্ব করবে নববী আদর্শ।
বাংলাদেশ সময়: ১২০৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০২৩
এএটি