প্রয়োজনে মানুষ তার আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। কিন্তু ঋণ পরিশোধ করার ক্ষেত্রে অনেকের হেয়ালি দেখা যায়।
ইসলামী শরিয়ত ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেছে। হাদিস শরিফে এসেছে- হযরত সামুরা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেন, ‘হাতের ওপর ওই বস্তুর দায়বদ্ধতা রয়েছে, যা সে গ্রহণ করেছে, যে পর্যন্ত না তা প্রাপকের নিকট ফিরিয়ে দেয়। ’ (বুখারী)। হযরত আবু উমামা (রা.) বিদায় হজ্জের ভাষণে নবী করীম সা. কে এই কথা বলতে শুনেছেন যে, ‘ধার নেওয়া বস্তু ফেরৎ দেওয়া অপরিহার্য’। (আবু দাউদ)।
রাসুল সা. বলেছেন, ‘ত্বরাপ্রবণতা শয়তানের পক্ষ থেকে উদ্ভুত; তবে পাঁচটি ক্ষেত্র ব্যতীত : ১. বয়প্রাপ্ত হলে মেয়েকে বিয়ের ব্যবস্থা করা, ২. মেয়াদ এসে গেলে ঋণ পরিশোধ করা, ৩. কেউ মৃত্যুবরণ করলে দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা, ৪. মেহমান আগমণ করলে তাকে আপ্যায়ন করা, ৫. গুনাহ হয়ে গেলে তাওবা করা। ’ (মিনহাজ)।
উল্লেখিত হাদিসসমূহ প্রমাণ করে যথাযথ ঋণ পরিশোধ অত্যাবশ্যক।
ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সূরা নিসা এর ১১ থেকে ১৪ নম্বর আয়াতে। আয়াতসমূহে মহান আলাহ তায়ালা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এমনকি তিনি তাঁর বান্দাদের নির্দেশ দিয়েছেন যেন মৃত ব্যক্তির ওসিয়ত ও ঋণ পরিশোধের পর তার পরিত্যাক্ত সম্পত্তি বন্টন করা হয়। ঋণমুক্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে তা জান্নাতের কারণ।
হাদিস শরিফে উলেখ রয়েছে যে, হযরত সাওবান রা. বলেন, রাসুলুলাহ সা. এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তির আত্মা অহংকার, আত্মসাৎ এবং ঋণ থেকে মুক্ত অবস্থায় দেহ ত্যাগ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। ’ (তিরিমিযী)। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল সা. বলেন, তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম লোক, যে উত্তমরূপে ঋণ পরিশোধ করে। ’ (বুখারী)।
কিছু লোক আছেন, যারা কোনক্রমে ঋণ গ্রহণ করে তা পরিশোধের কথা বেমালুম ভূলে যান।
এতে সামাজিক ন্যায়-নীতি প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং সংশিষ্ট ব্যক্তির সাথে ভালোবাসার বন্ধন ছিন্ন হয়। এক্ষেত্রে একটি আরবি প্রবাদ প্রচলিত আছে যে, ‘ঋণ ভালবাসার কঁচি স্বরূপ। ’ হযরত আব্দুলাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, যদি কোন ব্যক্তির মধ্যে গড়িমসি (দেবো-দিচ্ছি) করার অভ্যাস থাকে তবে সে দুষ্টু লোক। আর গড়িমসি করা এক প্রকারের জুলুম। (মুসান্নাফ ইবনু আবি শায়বা)।
হযরত আব্দুলাহ বিন ওমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুলাহ সা. বলেন, ‘একমাত্র ঋণ ছাড়া শহীদের সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেয়া হয়। ’ (মুসলিম)। হযরত আবু কাতাদাহ রা. বলেন, এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল : ‘ইয়া রাসুলালাহ! আপনি কি মনে করেন, যদি আমি আলাহর পথে অগ্রগামী অবস্থায় পশ্চাদপদ না হয়ে সওয়াবের আশায় দৃঢ়পদ থেকে শহীদ হই, তাহলে আলাহ আমার সব পাপ ক্ষমা করে দিবেন কী?’ রাসুলুলাহ সা. বলেন, ‘হ্যাঁ’। অতঃপর লোকটি চলে যেতে লাগলে তিনি পেছন থেকে ডেকে বললেন, ‘হ্যাঁ, তবে ঋণ ব্যতিত। ’ (মুসলিম)।
হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম সা. এর নিকট জানাযা আনা হলো যেন তিনি জানাযার নামায পড়ান। অতঃপর তিনি বললেন, ‘তার উপর ঋণ আছে কী?’ লোকেরা বলল, ‘হ্যাঁ’। রাসুল সা. বললেন, ‘জিবরাইল আ. আমাকে যার উপর ঋণ রয়েছে তার জানাযা পড়াতে নিষেধ করেছেন। ’ (তারগীব)। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুলাহ সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পরিশোধ করার ইচ্ছা নিয়ে কারো কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে, আলাহ তার ঋণপরিশোধের ব্যবস্থা করে দেন।
আর যে আত্মসাৎ করার মনোভাব নিয়ে কারো কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে, আলাহ তাকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করেন। ’ (বুখারী)। হযরত আবু মূসা আশয়ারী রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেছেন, ‘আলাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ কবিরা গুনাহসমূহের পরে সবচেয়ে নিকৃষ্ট কবিরা গুনাহ হলো কোন বান্দার আলাহ তায়ালার সাথে এমতাবস্থায় সাক্ষাত করা যে, তার উপর ঋণ রয়েছে, অথচ পরিশোধযোগ্য কিছুই সে রেখে যায়নি। ’ (আবু দাউদ)।
হযরত মায়মুন কুরদি রা. তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, আমি রাসুললুলাহ সা. কে বলতে শুনেছি যে, ‘যদি কোন ব্যক্তি কম বেশি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মহর ধার্য করে বিবাহ করে, কিন্তু মনে মনে স্ত্রীর হক আদায় করার ইচ্ছা রাখে না বরং ধোকা দিয়ে থাকে। অতঃপর পরিশোধ করা ছাড়াই মৃত্যুবরণ করলো, তাহলে লোকটি কিয়ামতের ময়দানে আলাহ তায়ালার সামনে যিনাকারী হিসেবে উঠবে। আর যে ব্যক্তি কারো থেকে ঋণ গ্রহণ করে তা পরিশোধ করার ইচ্ছা রাখে না বরং ধোকা দিয়ে অন্যের মাল গ্রাস করে; অতঃপর সে অপরিশোধিত অবস্থায় মারা গেলে আলাহ তায়ালার সামনে চোর সাব্যস্ত হয়ে উঠবে। ’ (তিবরানী)।
তাফসিরে মা’রিফুল কুরআনে বর্ণিত আছে যে, ‘যদি স্ত্রীর মোহরানা পরিশোধ করা না হয়ে থাকে তবে অন্যান্য ঋণের মতই প্রথমে মোট ত্যাজ্য সম্পত্তি থেকে মোহরানা পরিশোধ করার পর ওয়ারিসদের মধ্যে বন্টন করা হবে। এই অবস্থায় যদি মৃত স্বামীর আর কোন সম্পত্তি অবশিষ্ট না থাকে, তবে অন্যান্য ঋণের মত সম্পূর্ণ সম্পত্তি মহরানা বাবদ স্ত্রীকে সমর্পণ করা হবে এবং এতে কোন ওয়ারিসই অংশ পাবে না। ’ হযরত ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুলাহ সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের উপর একটি দিনার অথবা একটি দিরহাম ঋণ রেখে মৃত্যুবরণ করলো তা তার পূণ্য থেকে পরিশোধ করা হবে। কেননা সেখানে কোনো দিনারও নেই দিরহামও নেই। ’ (ইবনে মাজাহ)।
ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করা এক প্রকার অর্থনৈতিক অপরাধ। ইসলাম এরকম অপরাধ নিরসনে নির্ণয় করেছে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। হাদিস শরিফে এসেছে- হযরত শারীদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. বলেন, ‘ধনী ব্যক্তির গড়িমসি করা তার মানহানী ও শাস্তিকে বৈধ করে দেয়। ’
ঋণ পরিশোধ সহজভাবে সম্পন্ন করতে মহান আলাহ পাক লিখনীর ব্যবহারে গুরুত্বারোপ করেন। ঋণদানে গৃহীত চুক্তিসমূহ মানুষের মগজে সীমাবদ্ধ থাকলে তার ব্যাত্যয় ঘটা স্বাভাবিক। তাছাড়া সমাজে বিশৃঙ্খলা ও বিবাদ- বিসম্বাদের সূত্রপাত ঘটতে পারে। তাই আলাহ পাক এ বিষয়ে সতর্ক সংকেত প্রদান করে বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা যখন পরস্পরে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ঋণের আদান-প্রদান কর, তখন তা লিখে নাও। ’ (সূরা বাকারা : ২৮২)। এই আয়াতের অনুসরণে ঋণদান করলে পরিশোধ সহজীকরণ সম্ভব। সহজে ঋণ পরিশোধ করতে হলে ব্যবসা, পশু পালন, হস্ত শিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানে অধিক মনযোগী হতে হবে এবং অকর্মণ্য লোকদের ব্যক্তিগত ঋণদান থেকে বিরত থাকতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৫, ২০২৪