পবিত্র মেরাজ শরীফ ইসলামের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। আজ মহান পবিত্র মেরাজ রজনী।
৬২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ রজব দিবাগত রাতে মহান আল্লাহ্ তাঁর হাবীব বিশ্ব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর সরাসরি সান্নিধ্যে নিয়ে যান। যা অন্য কোনো নবীর বেলায় ঘটেনি। সশরীরে প্রত্যক্ষ করান সাত আসমান, বেহেস্থ, দোজখসহ মহান আল্লাহর সৃষ্টির রহস্যসমূহ।
পবিত্র মেরাজ বিশ্ব নবীর জীবনের এমন একসময়ে সংঘটিত হয়েছিল, যখন বিশ্ব নবীর জীবন খুব কষ্টের এবং সংকটময় ছিল।
কুরাইশরা যখন বিশ্ব নবী এবং তাঁর অনুসারীদের সামাজিকভাবে বর্জন করেছিল, হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রা:), বিশ্ব নবীর চাচা আবু তালিবের ইন্তেকাল এবং তায়েফবাসীর বিভিন্ন উপায়ে লাঞ্ছনাসহ সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি তখন বিশ্ব নবীকে মানসিকভাবে খুব মর্মাহত করে তুলেছিল।
আর সেই সময় মহান আল্লাহ্ তাঁর বন্ধু বিশ্ব নবীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন পরম সাক্ষাতের। পবিত্র মেরাজ শরীফের ঘটনা পবিত্র কোরআন শরীফ এবং হাদিস শরীফে খুব স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।
সুরা বনি ইসরাইলের শুরুতে পবিত্র মেরাজের বর্ণনা দেখতে পায় আমরা। মহান আল্লাহ্ ইরশাদ করেন- ‘পবিত্র ও মহীয়ান তিনি, যিনি তাঁর প্রিয় বান্দাহ (মুহাম্মদ)কে রাতের বেলায় ভ্রমণ করিয়েছেন মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার চারপাশকে আমি বরকতময় করেছি, তাঁকে (মুহাম্মদ) আমার নিদর্শনাবলি দেখানোর জন্য। তিনি সবকিছু শোনেন সবকিছু দেখেন। ’
পবিত্র কোরআনের সুরা নজমের ১৩ থেকে ১৮ নম্বর পর্যন্ত আয়াতেও পবিত্র মেরাজের বর্ণনা পাওয়া যায়।
মহান আল্লাহ্ ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় সে তাকে আরেকবার দেখেছিল সিদরাতুল মুনতাহার নিকটে, যার কাছে অবস্থিত রয়েছে বসবাসের জান্নাত। যখন বৃক্ষটি যা দ্বারা আচ্ছন্ন হওয়ার, তদ্বারা আচ্ছন্ন ছিল। তাঁর দৃষ্টিভ্রম হয়নি এবং তিনি সীমা লঙ্ঘনও করেননি। নিশ্চয় তিনি তার পালনকর্তার মহান নিদর্শনাবলি প্রত্যক্ষ করেছে। ”
পবিত্র কোরআন শরীফের পাশাপাশি পবিত্র হাদীস গ্রন্থ বুখারি মুসলিমসহ অসংখ্য সহীহ হাদীসে পাকে মেরাজের দীর্ঘ বর্ণনা আমরা দেখতে পাই।
হযরত আনিস র: হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- আল্লাহর হাবীব বিশ্ব নবী মেরাজের ঘটনা বর্ণনায় বলেন- আমি একবার পবিত্র কাবাঘরের নিকট ঘুমন্ত এবং জাগ্রত অবস্থার মাঝামাঝি অবস্থায় ছিলাম। এমতাবস্থায় জ্ঞান এবং ইমানে পরিপূর্ণ একটি স্বর্ণের পাত্র আমার নিকট আনা হলো। আমার বক্ষ খুলে জমজমের পানি দিয়ে ধৌত করে তা জ্ঞান এবং ইমানের মাধ্যমে পরিপূর্ণ করে দেওয়া হলো। তারপর আমার নিকট বেহেস্থি বাহন বোরাক উপস্থাপন করা হলো। আমি তাতে চড়ে প্রথমে বায়তুল মুকাদ্দাস গেলাম। সাথে ছিল হযরত জিবরাইল আঃ।
মসজিদের দরজার হুকের সাথে বোরাক বেঁধে রাখা হলো। আমি সেখানে সমস্ত নবিদের নিয়ে তাঁদের ইমাম হয়ে দুই রাকাত নামাজ পড়ালাম। এরপর হযরত জিবরাইল আঃসহ উর্ধ্বাকাশে ভ্রমণ শুরু করলাম। বিশ্ব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- আমি যখন পৃথিবীর আকাশের নিকটবর্তী হলাম, প্রথম আসমানের নিকট পৌঁছাতেই ওপর থেকে আমাদের পরিচয় জানতে চেয়ে জিজ্ঞেস করা হলো- কে এসেছেন? হযরত জিবরাইল আঃ বললেন, আমি জিবরাইল।
এবার জানতে চাওয়া হলো সাথে কে এসেছেন? উত্তরে হযরত জিবরাইল আঃ বললেন, আমার সাথে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসেছেন।
বলা হলো, ওনাকে কী আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে? হযরত জিবরাইল আঃ বললেন, হ্যাঁ জানানো হয়েছে। তখন আসমানের ফেরেশতারা বিশ্ব নবীকে স্বাগত জানিয়ে বললেন, নবিজীর আগমন মোবারক হোক।
বিশ্ব নবী বলেন, প্রথম আসমানে হযরত আদম আঃ এর সাথে সাক্ষাত করে সালাম দিলাম। তিনি আমাকে স্বাগত জানিয়ে বললেন, আমার গর্বিত সন্তান ও নবির আগমনকে মোবারকবাদ জানাই।
দ্বিতীয় আসমানে হযরত ঈসা আঃ ও হযরত ইয়াহইয়া আঃ এর সাক্ষাত পেলাম। উভয়ে আমাকে স্বাগত জানালেন। তৃতীয় আসমানে হযরত ইউসুফ আঃ আমাকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, আমার ভাই এবং নবির আগমন ভালো হোক।
চতুর্থ আসমানে হযরত ইদ্রিস আঃ, পঞ্চম আসমানে হযরত হারুন আঃ, ষষ্ঠ আসমানে হযরত মুসা আঃ এর সাথে দেখা হলো। সর্বশেষ সপ্তম আসমানে হযরত ইব্রাহিম আঃ এর সাথে সাক্ষাত হলে তিনি স্বাগত জানিয়ে বলেন, আমার সন্তান এবং নবিকে স্বাগত।
এরপর আমরা পৌছালাম উর্ধ্বাজগতের শেষ সীমা সিদরাতুল মুনতাহায়। এরপরই মহান আল্লাহর আরশ।
সিদরাতুল মুনতাহায় গিয়ে হযরত জিবরাইল আঃ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! সিদরাতুল মুনতাহা হচ্ছে আমার বিচরণের শেষ সীমানা। এর ওপরে আমার যাওয়ার অনুমতি নেই। আপনাকে একাই যেতে হবে।
সেখানে নবিজীর জন্য ‘রফরফ’ নামক বিশেষ বাহন প্রস্তুত করি রাখা হয়েছিল। তাতে করে নবিজী মহা আল্লাহর আরশে পৌঁছালেন।
সেখানে মহান আল্লাহর সাথে নবিজীর আরাধ্য সাক্ষাত হয়, সরাসরি সশরীরে কথা হয়। মহান আল্লাহ্ তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর সান্নিধ্যে ডেকে নিয়ে তাঁর হাবীবের সম্মানার্তে উম্মতে মুহাম্মদির জন্য বিশেষ উপহার প্রদান করেন।
সেটি হলো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। যা আদায় করলে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের সওয়াব পাওয়া যাবে। তাছাড়া নামাজ সমস্ত খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখার পাশাপাশি দেহ মনকে রাখে পবিত্র এবং সুস্থ।
নামাজ চেহেরার ঔজ্জ্বল্যতা বাড়ায়। মনকে অস্থিরতা থেকে মুক্ত রাখে। মেরাজ পরবর্তী মহান আল্লাহ্ তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরমারফত সুরা বনি ইসরাইলেরমাধ্যমে কিছু শিক্ষা মানবজাতির সামনে উপস্থাপন করেন।
যা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য
▪ মহান আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক না করা।
▪ মা বাবার সাথে উত্তম ব্যবহার করা।
▪ নিজ গুনাহের জন্য মহান আল্লাহর নিকট তাওবা করা।
▪️আত্মীয়স্বজনের হক আদায় করা।
▪ অপচয় অপব্যয় করা থেকে বিরত থাকা।
▪ মানুষের অধিকার আদায়ে ব্যর্থ হলে বিনয়ের সাথে তা প্রকাশ করা।
▪ মিতব্যয়ী হওয়া এবং কৃপণতা পরিহার করা।
▪ সন্তান হত্যা না করা।
▪ যেনা ব্যভিচার না করা।
▪ কোন জীবনকে অন্যায়ভাবে হত্যা না করা।
▪ প্রতিশোধ গ্রহণে কঠোর না হওয়া।
▪ এতিমের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ না করা।
▪ ওজনে কম না দেওয়া।
▪ যে বিষয়ে জানা নেই সে বিষয়ে মতামত দেওয়া থেকে বিরত থাকা।
▪ অহঙ্কার করে জমিনে চলাচল করা থেকে বিরত থাকা। কারণ, সবাইকে একদিন না একদিন জমিনের নিচে যেতে হবে।
মেরাজ শরীফের মূল আবেদন নামাজ প্রতিষ্ঠা এবং মেরাজ পরবর্তী দেওয়া নির্দেশনাসমূহ ব্যক্তি জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই ন্যায়ভিত্তিক, শান্তিময় সমাজ দেশ সর্বোপরি বিশ্ব বিনির্মাণ করা সম্ভব হবে।
মহান আল্লাহ্ আমাদের মেরাজ শরীফের শিক্ষাগুলো গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের তাওফিক দিন।
লেখক: কলামস্টি ও সংগঠক