নীলফামারী: ধর্মীয় সম্প্রীতির এক অনন্য স্থাপনা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী চিনি মসজিদ। নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরের ইসলামবাগ এলাকায় এ মসজিদের অবস্থান।
মসজিদটি নির্মাণে প্রধান কারিগর হিসাবে কাজ করেছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি। আর মসজিদটির দেয়াল ঘেঁষে সমসাময়িক সময়ে গড়ে ওঠে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের কবরস্থান।
চিনি মসজিদটি দেখতে প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক ও দর্শনার্থী ছুটে আসেন সৈয়দপুরে।
দৃষ্টিনন্দন চিনি মসজিদটি ১৮৬৩ সালে সৈয়দপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়।
মসজিদের মুসল্লিরা জানান, সৈয়দপুর হচ্ছে একটি প্রাচীন জনপদ। তারা লোকমুখে শুনেছেন এই জনপদের পাশ ঘেঁষে সরমঙ্গলা নামে একটি নদী প্রবাহিত হতো। এখন সেই নদী মৃতপ্রায়। ১৬০০ শতকে ওই নদী দিয়ে এই জনপদে মুসলমানদের আগমন ঘটে।
প্রবীণ পুথি লেখক ও কবি আবুল হোসেন আদানি স্থানীয় একটি পত্রিকায় তার নিবন্ধে লিখেছিলেন আফগানিস্তানের কাবুল থেকে সৈয়দ বংশের কিছু মানুষ কাফেলা নিয়ে সৈয়দপুরে এসেছিলেন। তখন এই জনপদ ছিল হিন্দু অধ্যুষিত।
নীলফামারী মহকুমার দারোয়ানী থানার অধীন ছিল সৈয়দপুর গ্রামটি। সৈয়দপুরের পূর্ব নাম জানা যায়নি। তবে ধর্মপ্রচারে আসা সৈয়দ বংশের জনগোষ্ঠীর কারণে জনপদটি সৈয়দপুর নামে পরিচিত হতে থাকে।
১৮৭০ সালে সৈয়দপুরে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানা গড়ে উঠে। তখন চলছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল। কারখানা প্রতিষ্ঠার অনেক আগে সৈয়দপুর শহরের ইসলামবাগ এলাকায় টিন ও শন দিয়ে চিনি মসজিদটি গড়ে ওঠে।
মসজিদটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তি হাজী বাকের আলী ও হাজী মক্কু। তারা সিদ্ধান্ত নেন ইসলামবাগে একটি মসজিদ গড়ার। মসজিদটিতে দিন দিন মুসল্লিদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ফলে কিছুদিনের মধ্যে দোচালা টিনের ঘরে রুপান্তর করা হয় মসজিদটিকে।
চিনি মসজিদ কমিটির সভাপতি সৈয়দপুর পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র হিটলার চৌধুরী ভুলু বলেন, দৃষ্টিনন্দন চিনি মসজিদ গড়ে তুলতে এর নেপথ্যে রয়েছে অনেক ইতিহাস। মসজিদ ঘিরে এলাকায় মুসলমানদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। এ অবস্থায় মসজিদের পরিসর বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এলাকার বাসিন্দা হাজী আব্দুল করিম নিজহাতে একটি নকশা তৈরি করেন। ১৯২০ সালে ওই নকশা অনুযায়ী চিনি মসজিদ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এলাকাবাসীর দেওয়া চাঁদায় কোলকাতা থেকে আনা হয় ২৪৩টি শংকর মর্মর পাথর।
এছাড়াও বগুড়ার একটি সিরামিক কারখানার মালিক বিনামূল্যে ২৫ টন ভাঙা কাপ-পিরিচের টুকরো সৈয়দপুরে পাঠিয়ে দেন মসজিদ নির্মাণের জন্য। মসজিদটি নির্মাণে দায়িত্ব পড়ে হিন্দু রাজমিস্ত্রী শঙ্ঘ রায়ের ওপর। তাকে সহযোগিতা করতে নামেন শত শত নারী ও পুরুষ।
সে সময় শঙ্ঘ রায়ের পারিশ্রমিক ছিল ১০ আনা। বাকি সব ছিল স্বেচ্ছাশ্রমের মানুষ। এদিকে মসজিদ নির্মাণের জন্য এলাকার নারীরা অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন। প্রতিদিন তারা মুষ্ঠির চাল সংগ্রহ করতেন এবং বৃহস্পতিবার তা বাজারে বিক্রি করে মসজিদ তহবিলে জমা দিতেন। অনুরূপ এলাকার হিন্দু-মুসলমান সবাই তাদের আয়ের একটি অংশ মসজিদ তহবিলে দান করতে থাকেন।
প্রয়াত বীরমুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী নূরুজ্জামান জোয়ার্দার সৈয়দপুর কে নিয়ে লেখা একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় ৩৯ বাই ৪০ ফুট আয়তনের চিনি মসজিদ পূর্ণাঙ্গতা পেয়ে যায়। মূল নকশা ও কারুকাজের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে দ্বিতল মসজিদটি আরও ২৫ ফুট সম্প্রসারণ করা হয়। এ কাজটি শেষ হয় ১৯৬৫ সালে।
কথা হয় চিনি মসজিদের ইমাম ও খতিব হাফেজ মাওলানা সাঈদ রেজার সাথে। তিনি বলেন, চিনা মাটি দিয়ে তৈরি বলে কেউ কেউ চিনি মসজিদকে চিনা মসজিদও বলেন। মসজিদটি মোগল আমলের স্থাপত্য। এর মেঝেতে ব্যবহার হয়েছে মার্বেল পাথর। মসজিদের সারা অবয়বজুড়ে খোদাই করে বসানো চিনা মাটির টুকরো। সূর্যের আলোতে তা ঝিকমিক করে। বহুদূর থেকে এর উজ্জ্বলতা দেখা দেয়। এই মসজিদে একসাথে ১২০০ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের গায়ে চিনামাটির নকশায় ফুল, ফুলের টব, চাঁদ তারা ও প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মন জুড়িয়ে যায়। এসব দৃশ্য মসজিদের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ।
তিনি আরও বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ও বিদেশ থেকে অনেক বুজুর্গ মসজিদটি দেখতে আসেন। মসজিদের ওপরতলায় একটি অংশে পর্যটক থাকার ব্যবস্থাও রয়েছে। মসজিদটিতে চারটি গম্বুজ ও ৪৮টি মিনার রয়েছে। তখন সিমেন্ট ব্যবহার হতো না। তাই মসজিদের গাঁথুনিতে চুন ও সুড়কি ব্যবহার করা হয়েছে। মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তে মুসল্লিদের প্রবেশের জন্য দুটি দৃষ্টিনন্দন ফটক রয়েছে। দক্ষিণ অংশে রয়েছে ওজুখানা। দুই ফটকের মাঝে আজান দেওয়ার জন্য একটি মিম্বর গড়ে তোলা হয়েছিল। এখন অবশ্য মাইকে আজান দেওয়া হয়।
মসজিদের মুসল্লি ও সৈয়দপুর পৌরসভার কাউন্সিলর আনোয়ারুল ইসলাম মানিক বলেন, চিনি মসজিদটি হচ্ছে আমাদের গর্বের একটি স্থাপনা। সারা দেশে এ ধরনের মসজিদ আর একটিও নেই।
নীলফামারী-৪ আসনের সংসদ সদস্য সিদ্দিকুল আলম বলেন, চিনি মসজিদটি যেহেতু মুসলিম ঐতিহ্যের স্মারক। তাই এটি সরকারি উদ্যোগে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। আমি এ ব্যাপারে ধর্ম মন্ত্রণালয়ে কথা বলব।
যোগাযোগ ব্যবস্থা:
সৈয়দপুর স্টেশন থেকে পূর্ব-উত্তর কোণে ২ কিলোমিটার দূরে মসজিদটি অবস্থিত। সৈয়দপুর বিমানবন্দর ও কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের দূরত্ব প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। সৈয়দপুর শহর থেকে ওয়াপদা মোড় সড়কের পাশে এটি অবস্থিত। প্রতি শুক্রবার মসজিদটিতে এক অভাবনীয় দৃশ্যের
অবতারণা হয়। ইবাদতের জন্য বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা লোকজন মসজিদে জায়গা না পেয়ে বাইরে জায়নামাজ পেতে জামাতে নামাজ পড়েন।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০২৪
এসএএইচ