রাশিয়া থেকে ফিরে: যাত্রাটা ছিল মূলত বিশ্ব যুব উৎসবের। তবে বিশ্ব যুব উৎসবে অংশ নেবো, আর তারুণ্যের আহ্বানে ভ্রমণ করবো না, তা কি হয়? তাইতো আয়োজনের মূল উৎসব শেষ হতেই রওনা হলাম সেন্ট পিটার্সবার্গে।
রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবাগের নাম শোনেননি, এমন মানুষ খুব কমই আছেন। কেউ কেউ তো এই শহরকে মস্কোর ওপরে রাখেন তাদের পছন্দের তালিকায়! এর পেছনে অবশ্য অনেক কারণ রয়েছে। প্রাচীন সময় থেকেই রাজধানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এই শহর। রাশিয়ানরা বলে- এটাই তাদের আদি রাজধানী।
রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী সেন্ট পিটার্সবার্গ। এটি ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পর্যটন শহর। রাশিয়ার সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবেও পরিচিত। রুশ সাম্রাজ্যের রাজধানী লেলিনগ্রাদই আজকের সেন্ট পিটার্সবার্গ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই শহর যেকোনো পর্যটকের প্রথম পছন্দ।
শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস, স্থাপত্য সব কিছুতেই অনন্য এ শহর। দু চোখে যা দেখি, তাই সুন্দর লাগে। এখানকার প্রতিটি বস্তু, পরিবেশ, সময় আপনাকে বলবে তার গৌরব গাথার কথা। আর এ শহরে যে নদী, তাও মন কাড়বে সকলের। বিশেষ করে নদীর ধার ধরে গড়ে ওঠা শহরের লোকালয়গুলো ছোট ছোট চ্যানেল দিয়ে সংযুক্ত। সেখানে হাঁটতে হাঁটতে মনেই হতে পারে ইতালির ভেনিসে চলে এসেছেন। তাই এটা বলায় যায় যে- যেই মানুষ ভালোবাসতে জানে, সে মানুষ এ শহরের প্রেমে পড়বেই।
এ এক আজব শহর। আবার আপনার মনে হবে ৩০০ বছর আগের এক রাজ-রাজার আমলে ঢুকে গেছেন। চারিদিকে গির্জা আর রাজ রাজাদের তৈরি করা স্থাপত্য। ত্রিইতস্কায়ার সামনে, হেয়ার আইল্যান্ডের পাশে, শহরের একদম সিটি সেন্টারে এসে চোখ আটকে যাবে! আরেহ, এই শহরে এত বিশাল আর এত সুন্দর মসজিদ এলো কোথা থেকে! কি সুন্দর নীল এক মসজিদ!
যেন পাহাড় কেটে, পাথর খুদিয়ে নীল নীল শত শত ছোট্ট চার কোনা খাঁজ তৈরি করা হয়েছে। কী অদ্ভুত কারুকার্য, কি সুনিপুণ তুলির দাগের মতো আলপনা। মুগ্ধতা যেন একেই বলে। আকাশের নীল, আর মসজিদের নীল কারুকার্য যেন মিলেমিশে একাকার। আর এটা এতটাই প্রাইম লোকেশন যে পাশেই পিটার অ্যান্ড পলস ফোর্ট্রেস আর ম্যানশন অব মাটিলদা বুঝিয়ে দিচ্ছে এই মসজিদের অবস্থানের মর্যাদা আর গুরুত্ব।
সেন্টা পিটার্সবাগ মসজিদ অনেকে চেনে ব্লু মস্ক নামে। পুরো ইউরোপের অন্যতম বড় মসজিদ হিসেবে পরিচিত এই মসজিদে একত্রে পাঁচ হাজার মানুষ নামাজ পড়তে পারেন। ছেলেরা নিচতলায়, মেয়েরা দ্বিতীয় তলায়। আর তিন তলায় একটা স্কুল আছে। সেখানে আরবি, ভাষা আর ইসলামিক জ্ঞানচর্চা করানো হয়।
রাজধানী মস্কো থেকে ৭০০ কিলোমিটার দূরে সেন্ট পিটার্সবার্গ। বাল্টিক সাগরের অন্তর্গত ফিনল্যান্ড উপসাগরের মোহনায় নেভা নদীর তীরে অবস্থিত সাজানো-গোছানো এই শহর। শহরের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত সেন্ট পিটার্সবার্গ মসজিদ- যেটি নীল মসজিদ নামে বেশি পরিচিত।
মুসলিমরা এই শহরে বাস করেছে সেই ক্যাথেরাইনের সময় কাল থেকে। কিন্তু অনেকটা লম্বা সময় ধরেই নিজস্ব উপাসনালয় ছিল না। বিখ্যাত স্থাপত্যবিদ নিকোলায়া আর এ. ভনের হাত ধরে, তারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল এমন সুন্দর এই স্থাপত্য তৈরি জন্য টেমারলেন্সের ইপক দেখে। ১৮০০ শতকে প্রস্তাবিত এই মসজিদটি টানা সাত বছর কাজ শেষে কল্পলোক থেকে বাস্তবতায় রূপ নেয়।
সে সময় রুশ সাম্রাজ্যের রানি ক্যাথেরিনের শাসনকালে সেন্ট পিটার্সবার্গের মুসলমানরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মীয় বিধি-বিধান মেনে চলতে পারত। কারণ, তারাই ছিল ওসমানি খিলাফত ও বুখারা সমরকন্দের সঙ্গে রাশিয়ায় যোগাযোগের বিশ্বস্ত মাধ্যম। তখন তাদের জন্য মসজিদ নির্মাণের অনুমতি ছিল না। প্রত্যেকে নিজ নিজ ঘরে নামাজ আদায় করতেন।
১৮৮১ সালে বুখারার আমির পুত্র পিটার্সবার্গ সফরকালে মসজিদ নির্মাণের জন্য অনুমতি চান। কিন্তু তৎকালীন সরকার সে আবেদন প্রত্যাখ্যান করে দেয়। ১৯০৪ সালে মসজিদ নির্মাণের আবেদনে সম্মতি জানিয়ে বুখারার আমিরকে চিঠি প্রেরণ করে সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাস। তখন তিনি মসজিদের জন্য জায়গা কেনেন। তবে পুনরায় বাধা দেওয়ায় নির্মাণকাজ স্থগিত হয়ে যায়। অবশেষে নির্মাণের অনুমতি পেয়ে ১৯১০ সালে শুরু হয়ে তিন বছরের মাথায় শেষ হয়।
মসজিদের দেয়ালে ও বিভিন্ন জায়গায় নান্দনিক কোরআনিক ক্যালিগ্রাফি মসজিদের শোভা বর্ধন করেছে। ১৯১৩ সালে বুখারার আমির মীর মুহাম্মদ আমির আলী খানের উপস্থিতিতে এই মসজিদ উদ্বোধন হয়। সেই সময় এটি ছিল তুরস্কের বাইরে ইউরোপের সবচেয়ে বড় মসজিদ।
শহরে টুরিস্ট বাস নিয়ে সিটি ট্যুর দিতে দিতে দেখতে পাবেন এই ‘নীল মসজিদ’! অথবা ম্যাপ ধরে নিজেই চলে যেতে পারবেন তাকে দেখতে। তেমনি গিয়েছিলাম আমিও, আর একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে এসে লিখছি আপনাদের জন্য....
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৫, ২০২৪
এইচএমএস/এসআইএস