পুলিশ বাহিনী আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ হলেও প্রাচীন পারস্য, রোম ও ইয়েমেনের মতো উন্নত সভ্যতা ও রাষ্ট্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অস্তিত্ব ছিল বলে ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়। ইসলামপূর্ব আরব উপদ্বীপে কোনো রাষ্ট্রীয় কাঠামো না থাকায় সেখানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও অস্তিত্ব ছিল না।
মহানবী (সা.) আরব উপদ্বীপে প্রথম আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গঠন করেন। মদিনার মুসলিমদের প্রতি মক্কার কুরাইশ ও তাদের মিত্রদের পক্ষ থেকে সৃষ্ট হুমকি এবং মদিনার উপকণ্ঠে বসবাসকারী মুসলিমদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একাধিক ‘টহল দল’ গঠন করা হয়। এসব বাহিনীতে তিন থেকে পঞ্চাশজন পর্যন্ত সদস্য অংশগ্রহণ করতেন। তারা মদিনার উপকণ্ঠের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে টহল দিতেন। তাদের ‘হিরাসুর-রাসুল’ বলা হতো।
মহানবী (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করলে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) অস্ত্র হাতে তাকে পাহারা দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসেন। তখন আনসারি সাহাবিরাও যেকোনো ধরনের হামলার ভয়ে নিজেদের প্রস্তুত রাখতেন। (আর রাহীকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ২০২; নবীয়ে রহমত, পৃষ্ঠা ২১৯)
এ ছাড়া মহানবী (সা.) বিভিন্ন যুদ্ধে মুসলমানের নিরাপত্তা রক্ষায় বিভিন্ন জনকে নিয়োগ দেন। যেমন বদরের যুদ্ধে সাদ বিন উবাদা, উসাইদ বিন হুদাইর ও সাদ বিন মুয়াজ (রা.)-কে, উহুদ যুদ্ধে মুহাম্মদ বিন মাসলামা (রা.)-এর নেতৃত্বে ৫০ জন সাহাবিকে, খায়বারের যুদ্ধে ইবাদ বিন বকর, মুহাম্মদ বিন আবি ওয়াক্কাস ও আবু আইয়ুব আনাসারি (রা.)-কে এবং খন্দকের যুদ্ধে আবদুল্লাহ বিন জুবায়ের (রা.)-কে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে নিয়োগ দেন।
ইসলামী রাষ্ট্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা ও মর্যাদা
আব্বাসীয় খলিফা আবু জাফর মনসুর (৭৫৪-৭৭৫ খ্রি.) ইসলামী সমাজে পুলিশের কাজ ও অবস্থান সম্পর্কে বলেন, ‘আমি আমার দরজায় চারজন পাহারাদার রাখার প্রয়োজন বোধ করি না। তবে আমি চার শ্রেণির মানুষ থেকে কখনো অমুখাপেক্ষী হতে পারি না। কেননা তারা রাষ্ট্রের স্তম্ভ। এক. বিচারক—যে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নে কোনো সমালোচকের সমালোচনার ভ্রুক্ষেপ করে না, দুই. পুলিশ—যে সবলের বিরুদ্ধে দুর্বলকে সাহায্য করে, তিন. রাজস্ব কর্মকর্তা—যে রাজস্ব সংগ্রহ করে কিন্তু অধীনদের প্রতি জুলুম করে না, চার. সংবাদবাহক—যে ওপরের তিন শ্রেণির সংবাদ যথাযথভাবে পৌঁছে দেয়। ’ (আল মুনতাজাম ফি তারিখিল মুলুকি ওয়াল উমাম : ৭/৩৪৭)
ইসলামের ইতিহাসে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল। তাদের সামাজিক অবস্থান ছিল অত্যন্ত উঁচু।
রাষ্ট্র পরিচালনায়ও তাদের মতামতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো। মিসরের শাসকদের দরবারে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মর্যাদা ছিল ঈর্ষণীয়। এই বাহিনীর প্রধান গভর্নরের অনুপস্থিতিতে নামাজের ইমামতি, রাষ্ট্রীয় কোষাগারের চাবি সংরক্ষণসহ অন্যান্য দায়িত্ব পালন করতেন। মিসরের সামরিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর জন্য ‘শুরতাতুল উলয়া’ নামের সাংবিধানিক পদ ছিল। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান নিয়মিত পাঠদান করতেন সেখানে। মিসরের শাসক প্রতিদিন তাঁকে সাক্ষাৎ দিতেন এবং দেশের অভ্যন্তরীণ সফরে তাঁকে সঙ্গে রাখতেন। শাসকের পক্ষ থেকে তাঁকে ‘তাবারজিন’ নামের ‘সোর্ড অব অনার’ প্রদান করা হতো এবং তিনি তা সব সময় বহন করতেন। (আল-খাতাতুল মুকাররিজিয়্যা : ১/৮৪১; আল-হাদারাতুল ইসলামিয়া ফিল কারনির রাবি আল-হিজরি : ২/২৭৫)
বাংলাদেশ সময়: ২০৪১ ঘণ্টা, মে ২২, ২০২৪