ঢাকা, শুক্রবার, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

পবিত্র শবেকদরের গুরুত্ব ও করণীয়

মুফতি এনায়েতুল্লাহ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৭ ঘণ্টা, জুলাই ২, ২০১৬
পবিত্র শবেকদরের গুরুত্ব  ও করণীয়

পবিত্র রমজান মাসের আজ ২৬ তারিখ। আজকের সূর্যাস্তের পর শুরু হবে মহিমান্বিত রজনী শবেকদর।

  পবিত্র কোরআন ও সহিহ হাদিস দ্বারা লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত। তাছাড়া লাইলাতুল কদরের জন্য হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) গৃহীত কর্মতৎপরতা এ রাতের গুরুত্বকে আরও বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। এ রাতের গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, 'আমি একে (কোরআনকে) কদরের রাতে নাজিল করেছি। তুমি কি জান, কদরের রাত কী? কদরের রাত হাজার মাস থেকেও উত্তম-কল্যাণময়। ' -সূরা আল কদর :১-৩

এ রাতটি কোন মাসে? এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, 'রমজান এমন মাস যাতে কোরআন নাজিল হয়েছে। ' -সূরা বাকারা :১৮৫

এ রাতটি রমজানের কোন তারিখে? হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) রহস্যময় কারণে তা সুনির্দিষ্ট করেননি। ইমাম বুখারি, ইমাম মুসলিম, ইমাম আহমদ ও ইমাম তিরমিজি (রহ.) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে- হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, 'কদরের রাতকে রমজানের শেষ দশ রাতের কোনো বিজোড় রাতে খোঁজ করো। '

হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিস থেকেও এ একই ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। অবশ্য অনেক বুজুর্গ নিজস্ব গবেষণা, গাণিতিক বিশ্লেষণ ইত্যাদির মাধ্যমে রমজানের ২৬ তারিখের রাতে শবেকদর হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা জোর দিয়ে বলেছেন।

এ রাতের গুরুত্ব বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো- এ রাতে কোরআন নাজিল হয়েছে। যে কোরআনের সঙ্গে মানুষের ভাগ্য জড়িত। অবশ্য কদর শব্দের আরেক অর্থ হলো ভাগ্য। সে হিসেবে লাইলাতুল কদরের অর্থ দাঁড়ায়- ভাগ্য রজনী। যে মানুষ, যে সমাজ, যে জাতি কোরআনকে বাস্তব জীবন বিধান হিসেবে গ্রহণ করবে, তারা পার্থিব জীবনে ও পরকালীন জীবনে সম্মানিত হবে। পক্ষান্তরে এ রাতে নাজিলকৃত কোরআনের কোনো বিধানকে যারা সামান্য অবহেলা করবে বা অস্বীকার করবে, তারা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। এ রাতে মানবকল্যাণে আল্লাহতায়ালা মানুষের জন্য চূড়ান্ত কিছু সিদ্ধান্ত ফেরেশতাদের জানান। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, 'এ রাতে প্রত্যেকটি ব্যাপারে অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত ও সুদৃঢ় ফায়সালা জারি করা হয়। ' -সূরা আদ দোখান :৪

কদর রাতের অনেক ফজিলত। এর কয়েকটি হলো- আজকের রাত হাজার মাস থেকে উত্তম ও কল্যাণময়। এ রাতে পবিত্র কোরআন নাজিল করা হয়েছে। এ রাতে ফেরেশতা নাজিল হয় এবং ইবাদতরত বান্দাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। ফজর পর্যন্ত এ রাত শান্তি ও নিরাপত্তা দ্বারা আবৃত। এ রাতে প্রত্যেকটি গুরুত্ব বিষয়ের সুদৃঢ় ফয়সালা জারি করা হয়। এ রাতে ইবাদতে মশগুল বান্দাদের জন্য অবতরণকৃত ফেরেশতারা তাদের কল্যাণে দোয়া করেন। এ রাতের কল্যাণ থেকে একমাত্র হতভাগ্য লোক ছাড়া আর কেউ বঞ্চিত হয় না। এ রাতে বান্দার গোনাহগুলো ক্ষমা করে দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হচ্ছে, 'যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ইমান সহকারে ও আল্লাহর নিকট থেকে বড় শুভফল লাভের আশায় ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে, তার পেছনের সব গোনাহ মাফ হয়ে যাবে। ' –সহিহ বোখারি ও মুসলিম

মর্যাদাপূর্ণ ও মহিমাময় এ রাতে আমাদের করণীয় হলো- বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত, নফল নামাজ, জিকির-আজকার ও দোয়া-দরুদে মশগুল থাকা। শবেকদরে আত্মসমালোচনা করে জীবনে কৃত সমস্ত অন্যায়, পাপাচার ও অনাচারের পথ থেকে ফিরে আসার নিমিত্তে তওবা-ইসতেগফার করা। দান-খয়রাত করে অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো।

শবেকদরে যথাসম্ভব নফল নামাজ বেশি বেশি পড়া। নফল নামাজ কমপক্ষে ৮ রাকাত থেকে শুরু করে যে কয় রাকাত মন চায় পড়া যাবে। নফল নামাজ পড়ার ক্ষেত্রে 'দুই রাকাত নফল পড়ছি'- এ নিয়তে নামাজ শুরু করে স্বাভাবিক নিয়মে নামাজ শেষ করতে হবে। বাজারে প্রচলিত কিছু বইয়ে শবেকদরের নামাজ বলে সূরা ফাতেহার পরে ৩৩ বার সূরা কদর, ৩৩ বার সূরা ইখলাস ইত্যাদি মিলিয়ে নামাজ পড়ার কথা উল্লেখ করে অহেতুক জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছে। বিদগ্ধ ও বরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদরা এগুলো জরুরি মনে করেন না। বরং ওই সংখ্যকবার সূরা পড়তে গেলে হিসাব মেলাতে মেলাতে নামাজের একাগ্রতা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে।

এ ছাড়া জীবনের কাজা নামাজ আদায়সহ সালাতুত তওবা, সালাতুল হাজত ও সালাতুত তাসবিহর নামাজ পড়া যায়। এসব নামাজ পড়ার নিয়ম-পদ্ধতি জানা না থাকলে আপনার নিকটস্থ মসজিদের ইমাম কিংবা কোনো আলেমের কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন। এছাড়া এসব নামাজের নিয়ম-পদ্ধতি লেখা সংবলিত বইও পাওয়া যায়, সেখান থেকে তা জেনে নিতে পারেন।

তবে আলেমরা বলেন, শবেকদরের শেষভাগে কমপক্ষে ৮ রাকাত তাহাজ্জুদ পড়ার চেষ্টা করা। কারণ এ নামাজ সর্বশ্রেষ্ঠ নফল নামাজ। আর রাতের এ অংশে দোয়া কবুল হয়। নফল নামাজের সংখ্যার হিসাবের চেয়ে নামাজের গুণগত দিকটির দিকে আমাদের বেশি লক্ষ্য রাখতে হবে।

শবেকদরে নফল নামাজের পাশাপাশি বেশি বেশি জিকির ও দোয়া করা যেতে পারে। হাদিসে যেসব দোয়া ও জিকিরের অধিক ফজিলতের কথা বলা হয়েছে সেগুলো পড়া। গোনাহ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা ও হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) ওপর দরুদ পাঠ আল্লাহতায়ালার কাছে খুব প্রিয় আমল। তাই শবেকদরে বেশি করে ইসতেগফার ও দরুদ পড়া যেতে পারে।

হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি হজরত রাসূলুল্লাহকে (সা.) বললাম- ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি যদি কোনোভাবে জানতে পারি রাতটি লাইলাতুল কদর, তাহলে কোন দোয়া করব? জবাবে নবী (সা.) বলেন, এ দোয়া পড়বে, 'আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা-ফুআন্নি’ অর্থাৎ আয় আল্লাহ! তুমি বড় ক্ষমা ও অনুগ্রহশীল। মাফ করে দেওয়াকে তুমি পছন্দ করো। অতএব, তুমি আমাদের গুনাহগুলো মাফ করে দাও। '

এ ছাড়া আল্লাহতায়ালা বান্দার দোয়া ও মোনাজাত দ্বারা খুব খুশি হন। হাদিসে বলা হয়েছে, 'যে আল্লাহর নিকট কিছু চায় না আল্লাহ তার ওপর রাগ করেন। ' কাজেই আমরা শবেকদরে কায়মনোবাক্যে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করব, ক্ষমা চাইব, রহমত চাইব, জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাইব। মনের আবেগ নিয়ে চাইব। চোখের পানি ফেলে চাইব। আল্লাহ আমাদের খালি হাতে ফেরাবেন না। তিনি অবশ্যই আমাদের প্রার্থনা শুনবেন। কারণ তিনি দয়াময় ও করুণার আঁধার।

তবে এ পবিত্র রাতে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ হতে দেখা যায়। এগুলো বন্ধ করার জন্য গঠনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এসব কাজ ইবাদতের পরিবেশকে বিঘ্নিত করে। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে শবেকদরের ফজিলত নসিব করুন এবং এ রাতের নিরাপত্তা ও কল্যাণ দ্বারা আমাদের আবৃত করে দিন।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৭ ঘণ্টা, জুলাই ০২, ২০১৬
এমএইউ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।