প্রতিটি জাতি-গোষ্ঠীর জীবনে এমন কিছু দিন আছে যাকে তারা তাদের জাতীয় উৎসবের দিন হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। যে দিনটির আগমন জাতির প্রত্যেকটি মানুষের জন্য আনন্দ উৎসবের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে।
বলাবাহুল্য, এই উৎসব-আনন্দে তাদের নিজ নিজ ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিশ্বাস, মানসিকতা প্রভৃতি মূর্ত হয়ে ওঠে। তবে পৃথিবীর অপরাপর জাতি-সম্প্রদায়ের উৎসব আনন্দ দিবসের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের চেয়ে মুসলমানদের ঈদ উৎসবের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আরও সুদূরপ্রসারী ও ব্যাপক। কেননা অন্যান্য জাতির আনন্দ-উৎসব পার্থিব সুখ-সম্ভোগ পূরণের জন্য হয়ে থাকে। অপরদিকে মুসলমানদের কামনা-বাসনা, ইচ্ছা একমাত্র আল্লাহতায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘(হে রাসূল!) আপনি বলে দিন যে, আমার নামাজ, আমার সব বন্দেগি, আমার জীবন এবং আমার মরণ সবই আল্লাহতায়ালার জন্য- যিনি সমগ্র বিশ্বের প্রতিপালক এবং যার কোনো অংশীদার নেই। ’
মুসলমানদের জন্য অফুরন্ত খুশির বার্তা নিয়ে হাজির হয় দুটি দিন- ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। ধনী-গরিব, ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মুসলমানের জীবনে ঈদ হাজির করে আনন্দের বন্যা। এমনকি আমাদের দেশে অন্যান্য ধর্মের মানুষকেও ঈদের আনন্দ স্পর্শ করে। মানবিক সাম্য, ত্যাগ ও সহমর্মিতার বিস্ময়কর ও অপরূপ আলোকপ্রভা ঈদের উৎসবে প্রকাশিত হয়, যা ইসলামের মহত্ত্ব ও সর্বজনীনতার প্রতীক।
আরবি ‘আওদ’ শব্দ থেকে ‘ঈদ’ শব্দের উৎপত্তি। এটি সাধারণত দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়- ১. আনন্দ, খুশি। এ অর্থটি পবিত্র কোরআনে ব্যবহৃত হয়েছে এবং হাদিসেও এসেছে। ২. অপর অর্থ বার বার হাজির হওয়া, ফিরে আসা প্রভৃতি। ঈদ প্রতি বছর আনন্দের পয়গাম নিয়ে হাজির হয়।
অপরদিকে আরবি ‘আজহা’ শব্দের অর্থ- ত্যাগ স্বীকার, কোরবানি প্রভৃতি। ঈদুল আজহায় আল্লাহর রাহে ত্যাগ ও কোরবানির চেতনা ভাস্বর হয়ে ওঠে। পশু জবেহ করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রচেষ্টা মানব ইতিহাসের জন্মলগ্ন থেকেই চলে আসছে।
মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর আদেশ পালনার্থে নিজ পুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.) কে কোরবানি করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। এ ঘটনায় কোরবানির গুরুত্ব ও তাৎপর্য আরও বেড়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রভুপ্রেমে প্রাণ উৎসর্গ করা একটা পুণ্যময় ইবাদত বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। কোরবানি এমন একটি মর্যাদাকর বিষয় যাতে রয়েছে একাধারে আত্মগঠন এবং সুস্থ সমাজ গঠনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপাদানাবলি।
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের মধ্যে কোনো ধরনের পার্থক্য নেই। পার্থক্য রয়েছে শুধু আল্লাহভীতির ক্ষেত্রে, সৎ ও অসতের মধ্যে, ঈমানদার ও বেঈমানের মধ্যে। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই তাৎপর্য অনুমেয়।
ঈদের শিক্ষা হলো সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও একাত্মবোধের মাধ্যমে আনন্দ উপভোগ এবং পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার সম্প্রসারণ। সমাজের গরিব অভাবী মানুষও যাতে এই মহানন্দে শামিল হতে পারে, সেজন্য ইসলাম নির্দেশনা দিয়েছে। ধনী-গরিবের একাকার হয়ে যাওয়ার এই ব্যবস্থা সত্যিই বিরল। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, জাতীয়, আন্তর্জাতিক, পারলৌকিক সব ক্ষেত্রেই ঈদের দাবি পরিব্যপ্ত। অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর উৎসবের মতো এটি সাময়িক সস্তা আনন্দ, তামাশা বা অর্থহীন উল্লাস নয়। আদর্শবাদিতা, মার্জিত রুচিবোধ আর শালীনতার প্রকাশ ঘটে এই উৎসবে। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য থেকে বিচ্যুত না হয়ে সামাজিকতা এবং মানবতাবোধকে সমুন্নত করাই ঈদের মূল তাৎপর্য।
এক কথায় বলা যায়, ঈদ ইসলামের সার্বজনীনতা এবং বিশ্বজনীনতাকে সমুন্নত করেছে। এর মধ্যে ইসলামের মূল সৌন্দর্য তথা বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের উপাদান নিহিত রয়েছে।
ইসলামের সোনালি দিনের মানুষরা ঈদের দিনে বেশি বেশি দান করতেন, বঞ্চিত-নিরন্ন মানুষদের খোঁজ নিতেন, দীর্ঘ সময় আল্লাহর ইবাদতে কাটাতেন। তাই ঈদের প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করে আমাদেরও নতুনভাবে জাগতে হবে। সমাজের অভাবী-দুঃখী মানুষগুলোকে সুখী-স্বাবলম্বী করে তুলতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
আজকের ঈদে এটাই হোক আমাদের অঙ্গিকার। সবাইকে ঈদ মোবারক।
বাংলাদেশ সময়: ০০০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৬
এমএইউ/