আজ বুধবার ১০ মহররম, পবিত্র আশুরা। মুসলিম উম্মাহর জন্য এক তাৎপর্যময় ও শোকাবহ দিন।
১০ মহররম বা আশুরা দিবসে ঐতিহাসিক বহুবিধ গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিবহ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে আশুরা দিবস বিভিন্ন ঘটনাপুঞ্জে সমৃদ্ধ থাকলেও সর্বশেষে সংঘটিত কারবালা প্রান্তরে হজরত ইমাম হোসাইনের (রা.) শাহাদাতই এ দিবসের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
পবিত্র আশুরা সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যময় একটি দিবস। আমরা জানি, পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসেবে শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম ইসলামে সব সময় সত্য প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও সহচরেরা ৬১ হিজরিতে এদিন ইয়াজিদের সৈন্যবাহিনীর হাতে কারবালায় নির্মমভাবে শহীদ হন। ইসলামের সুমহান আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য তার এ আত্মত্যাগ ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য ত্যাগের মহিমা মুসলিম উম্মাহর জন্য এক উজ্জ্বল ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। হজরত হোসাইনের (রা.) জুলুম-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার এবং অসত্য ও অন্যায় প্রতিরোধের ঘটনায় রয়েছে মানবজীবনের জন্য শিক্ষণীয় অনেক কিছু।
নবী-দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ছিলেন সত্যের প্রতীক। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাতিলের রক্তচক্ষু তাকে এতটুকু বিচ্যুত করতে পারেনি। কারবালার ঘটনা মানবজাতির ইতিহাসে এক মর্মন্তুদ শোকাবহ ঘটনা হিসেবে স্থান পেয়েছে। এখন পর্যন্ত সারা দুনিয়ার মুসলিম সমাজ, এমনকি জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে নিপীড়িত মানুষ এ শোকাবহ ঘটনাকে স্মরণ করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রেরণা লাভ করেন। কারবালার ঘটনা শুধু একজন ব্যক্তি বা একটি পরিবারের সুমহান আত্মত্যাগের কাহিনী নয়, এটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়সংগত প্রতিবাদের এক অনন্য সাধারণ বীরত্বগাথা। অপরদিকে এ ঘটনার ভেতর দিয়ে ক্ষমতালোভী মানুষের নৈতিক অধঃপতন, ক্ষমতার মোহ ও অর্থলিপ্সার হীন চরিত্র ফুটে উঠেছে।
কারবালা ট্র্যাজেডির বদৌলতেই ইসলাম স্বমহিমায় পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। সেদিন ইমাম হোসাইন (রা.) যদি ইয়াজিদের সঙ্গে আপস করতেন, তাহলে রাজ সিংহাসন তার বশীভূত হতো। কিন্তু নিজের স্বার্থ ও ক্ষমতালিন্সা তাকে গ্রাস করেনি। লোভ-মোহের ঊর্ধ্বে উঠে ইমাম হোসাইন (রা.) বুকের তাজা রক্ত প্রবাহিত করে ইসলামের চিরশাশ্বত নীতি ও আদর্শকে সমুন্নত করলেন। কারবালার রক্তাক্ত সিঁড়ি বেয়েই ইসলামের পুনরুজ্জীবন ঘটে।
হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর সপরিবারে শাহাদাতবরণের ঘটনা ১০ মহররম আশুরাকে দিয়েছে বিশেষ মাত্রা ও ত্যাগের মহিমা। এদিন শুধু শোক আর বেদনা নয়, বরং কারবালা আমাদের অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে, আত্মত্যাগে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। ইমাম হোসাইন (রা.) অসত্য ও অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি। ফোরাত নদীর তীরে ইয়াজিদের অন্যায় দাবি মেনে নেওয়ার পরিবর্তে তিনি এক অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনবাজি রেখে সপরিবারে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। তাদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি, ইসলামের ইতিহাস তাদের অমর করেছে। কারবালার শোকাবহ ঘটনার স্মৃতিতে ভাস্বর পবিত্র আশুরায় শাশ্বত বাণী তাই আমাদেরকে অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার হতে উদ্বুদ্ধ করে এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার প্রেরণা জোগায়।
বস্তুত, কারবালার ঘটনা কোনো আহাজারি কিংবা মাতমের বিষয় নয়, এটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যের লড়াই। ইমাম হোসাইন (রা.) আজ অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে গণ্য। বিশ্বজুড়েই আজ সত্য-অসত্যের ও ন্যায়-অন্যায়ের দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছে। অসত্য ও অন্যায়ই যেন প্রবলভাবে বিরাজমান। যে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নবী-দৌহিত্র কারবালায় আত্মত্যাগ করেছিলেন, সেই চেতনার অভাবের কারণে আজ অসত্য ও অন্যায়ের প্রবল প্রতাপ। আশুরার শিক্ষা আমাদের সব অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অংশ নেওয়ার সাহস জোগায়, আত্মত্যাগের আহ্বান জানায়।
আসলে, কারবালার সেই চেতনাকে ধারণ করতে না পারলে, শুধু শোক আর মাতম করে কোনো লাভ নেই। যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, অসত্য ও স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং কোনো দেশ-জাতি-রাষ্ট্র বা সমাজে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হলে সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিরোধ করাই কারবালার অতুলনীয় শিক্ষা। বিষয়টি মনেপ্রাণে উপলব্ধি করে তা ধারণই হলো আশুরার মূল শিক্ষা।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০১৬
এমএইউ/