পরিবার ও জাতির কল্যাণে মিতব্যয়ী হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে প্রতি বছর ৩১ অক্টোবর সারা বিশ্বে একসঙ্গে পালিত হয় ‘বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবস। ’ মিতব্যয় ও সঞ্চয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করার উদ্দেশ্য নিয়ে দিবসটি পালন করা হয়।
অপব্যয়রোধ ও সঞ্চয় ব্যক্তি, সমাজ এবং সর্বোপরি জাতির জন্য কল্যাণকর। এই সঞ্চিত অর্থ ব্যবহৃত হতে পারে যে কোনো উন্নয়নমূলক কাজে, যা দিতে পারে স্বনির্ভরতা। মিতব্যয় সম্পর্কে সূরা ফুরকানের ৬৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘রহমানের বান্দা তারাই ... যারা ব্যয়ের সময় অপব্যয় করে না আবার কার্পণ্যও করে না। বরং এ দু’য়ের মাঝে মধ্যপন্থায় তারা থাকে। ’
মিতব্যয় প্রসঙ্গে সূরা বনি ইসরাইলের ২৬-২৯ নম্বর আয়াতে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘অপচয় করো না। অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই। ... তুমি (কার্পণ্য করে) তোমার হাত ঘাড়ে আটকে রেখ না; আবার (অধিক ব্যয় করতে যেয়ে) তা সম্পূর্ণ প্রসারিত করো না। তাহলে তুমি নিন্দিত ও নিঃস্ব হয়ে যাবে। ’
ইসলামি স্কলাররা অপচয় বা অপব্যয়ের বিভিন্ন পরিচয় দিয়েছেন। হজরত ইবনে মাসউদ ও ইবনে আব্বাসের (রা.) মতে, ‘অপ্রয়োজনে ব্যয় করাই হল অপব্যয়। ’ আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রয়োজন অনুপাতে ব্যয় করা ইসলামের নির্দেশ। সম্পদ থাকতে নিজে কষ্ট করা, স্ত্রী ও সন্তানকে কষ্টে রাখা, নিকটতম আত্মীয়-স্বজনদের দেখাশোনা না করা, পাড়া-প্রতিবেশিদের খোঁজ-খবর না নেওয়া হারাম। এগুলোই কৃপণতা। আবার অঢেল সম্পদ থাকলে প্রয়োজনের অধিক অতিরিক্ত ব্যয় করা অপব্যয়ের শামিল।
যেকোনো অপচয় দেশ, সমাজ ও পরিবারের জন্য ক্ষতিকর। তাই কোরআনে কারিমে অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ইসলামে অপচয় ও অপব্যয় উভয়ই নিষিদ্ধ। অপচয় ও অপব্যয় যে পরিবার ও সমাজে আর্থিক দৈন্যতা বাড়ায়। অপচয় ও অপব্যয়ের নানাবিধ ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে ইসলামে তা নিষিদ্ধ। অপচয় ও অপব্যয়ের কারণে বৈষয়িক ক্ষতির পাশাপাশি আত্মিক ক্ষতিও ঘটে। অপচয় ও অপব্যয়ের কারণে বরকতও হ্রাস পায়। এর ফলে মানুষের ধন-সম্পদ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়।
ইসলাম সর্বদা মানুষকে ভারসাম্য রক্ষা করে চলার উপদেশ দেয় এবং ঐশী অনুগ্রহের ব্যাপারে কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন ও অর্থ-সম্পদের সদ্ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করে। মিতব্যয় মানুষের সম্পদকে বৃদ্ধি করে এবং অন্যকে সাহায্য করার পথ উন্মুক্ত রাখে। মিতব্যয়ীরা কখনোই নিঃস্ব হয় না। অপচয় ও অপব্যয়ের কারণে মানুষ ইহকাল ও পরকাল দু’টোকেই হারায়।
তবে মিতব্যয় আর কৃপণতা কিন্তু এক নয়। মিতব্যয় হচ্ছে- যেখানে যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু ব্যয় করা ও সম্পদের অপচয় না করা। কিন্তু কৃপণতা হলো, যেখানে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু ব্যয় না করা। এ কারণে ইসলামে অপচয় ও অপব্যয়ের মতো কৃপণতাও নিষিদ্ধ।
পবিত্র কোরআন ও হাদিসে ক্ষুধার্তকে খাদ্যদান, বস্ত্রহীনকে বস্ত্রদান, অভাবগ্রস্তকে সাহায্য প্রদান, অনাথ-ইয়াতিমদের লালন-পালন, নিঃস্ব ব্যক্তিদের উপার্জনের ব্যবস্থা করা এবং বিপদগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করাকে মুসলমানদের কর্তব্য বলে ঘোষণা হয়েছে। কিন্তু কৃপণরা তা করে না। এ কারণেই কৃপণতা মানুষকে জান্নাত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
ইসলামি অর্থনীতিতে অপচয় ও অপব্যয় কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের সমাজের অপচয়ের নানা দিক পরিলক্ষিত হয়। এর মাঝে সময়ের অপচয় অন্যতম। কেউ যদি সময়কে সঠিকভাবে কাজে না লাগিয়ে তা অবহেলায় কাটিয়ে দেয়, তাহলে এর চেয়ে ক্ষতিকর আর কিছুই হতে পারে না। একেকটি মুহুর্ত একেকটি সুযোগ। কারোরই উচিত নয় একটি মুহুর্তও অপচয় করা।
মানব সম্পদ ও শক্তিকে সঠিক উপায়ে ব্যবহার না করাও এক ধরনের অপচয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, একজন ব্যক্তি যে কাজে অধিক পারদর্শী তাকে দিয়ে সে কাজ না করিয়ে অন্য কাজ করানো হচ্ছে অথবা অধিক পারদর্শী লোককে উপযুক্ত কাজে নিযুক্ত করা হচ্ছে না। এর মাধ্যমে অপব্যয় ও অপচয় বেড়ে যাচ্ছে। দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাবে অনুপযুক্ত স্থানে চাকুরি পাওয়া ব্যক্তিরা অনিচ্ছাকৃতভাবে সম্পদ অপচয় করছে। এক কথায়, স্বাভাবিকভাবেই যা কিছু মানুষের জন্য ক্ষতিকর তার সবই অপচয় ও অপব্যয় হিসেবে গণ্য।
এভাবে দিনের বেলা জানালা বন্ধ রেখে বাতি জ্বালানো, বৈদ্যুতিক পাখা ছেড়ে দিয়ে রুমের বাইরে চলে যাওয়া, পানির কল বন্ধ না করা, গ্যাসের চুলা নিভিয়ে না রাখা, হোটেল-রেস্টুরেন্টে অর্ডার দিয়ে অর্ধেক খেয়ে বাকীটুকু নষ্ট করাও অপচয়ের অন্তর্ভুক্ত। এসব থেকে বিরত থাকা দরকার।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০১৬
এমএইউ/