শুরু হয়েছে আরবি সফর মাস। সফর হিজরি সালের দ্বিতীয় মাস।
ফারসি শব্দ আখেরি চাহার শোম্বা অর্থ শেষ চতুর্থ বুধবার। সফর মাসের শেষ বুধবারকে ‘আখেরি চাহার শোম্বা’ বলা হয়। বলা হয় হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সফর মাসের শেষের দিকে অসুস্থ হন। তিনি সফর মাসের শেষদিকে কিছুটা সুস্থ হন এবং গোসল করেন। এর পর তিনি পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এই অসুস্থতাতেই তিনি পরের মাসে ইন্তেকাল করেন। এ জন্য অনেকে এই দিনে রাসূলের সর্বশেষ সুস্থতা ও গোসলের স্মৃতি উদযাপন করেন। এ কারণে দিনটি মুসলমানেরা ‘শুকরিয়া দিবস’ হিসেবে পালন করেন।
এ দিনকে ঘিরে এমন আরও অনেক কথা প্রচলিত রয়েছে। তবে ইসলামি স্কলারদের অভিমত হলো, উপরোক্ত বিষয় এবং এ মাসের ফজিলত বিষয়ে যা কিছু বলা হয়- তার সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। এমন কোনো বর্ণনা হাদিসে নেই। আরও মজার বিষয় হলো- ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া অন্য কোনো মুসলিম সমাজে সফর মাসের শেষ বুধবার পালনের রেওয়াজ নেই। তারা জানেও না আখেরি চাহার শোম্বা কী!
বিশুদ্ধ হাদিস ও সীরাতের গ্রন্থে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অসুস্থতা, অসুস্থকালীন অবস্থা, কর্ম ও ইন্তেকাল ইত্যাদির ঘটনা বিস্তারিত বর্ণিত আছে। কিন্তু কোথাও কোনোভাবে, কোনোদিন, তারিখ বা সময় উল্লেখ করা হয়নি। এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে।
অসুস্থ হওয়ার পরে মাঝে কোন দিন তিনি সুস্থ হয়েছিলেন এটা কেউ উল্লেখ করেননি। তবে কয়েকদিন অসুস্থ থাকার পর তিনি গোসল করেছিলেন বলে সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, হরজত রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন আমার ঘরে প্রবেশ করলেন এবং তার অসুস্থতা বৃদ্ধি পেল, তখন তিনি বললেন, তোমরা আমার ওপরে ৭ মশক পানি ঢাল, যেন আরামবোধ করে লোকদের নির্দেশনা দিতে পারি। তখন আমরা এভাবে তার দেহে পানি ঢাললাম। এরপর তিনি মানুষের নিকট যেয়ে তাদের নিয়ে নামাজ আদায় করলেন এবং তাদেরকে ওয়াজ করলেন। -সহিহ বোখারি
এখানে স্পষ্ট যে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তার অসুস্থতার সময় অসুস্থতা ও জ্বরের প্রকোপ কমানোর জন্য এভাবে গোসল করেন। যেন কিছুটা আরামবোধ করেন এবং মসজিদে যেয়ে সবাইকে নসিহত করতে পারেন। এই গোসল করার ঘটনা কত তারিখে বা কী বারে ঘটেছিল তা হাদিসের কোনো বর্ণনায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি।
তবে আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানি সহিহ বোখারি ও সহিহ মুসলিমসহ অন্যান্য হাদিসের সঙ্গে এই হাদিসের সমন্বয় করে উল্লেখ করেছেন যে, এই গোসলের ঘটনাটি ঘটেছিল ইন্তেকালের আগের বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ইন্তিকালের ৫ দিন আগে। -ফাতহুল বারি: ৮/১৪২
সে হিসেবে ১২ রবিউল আউয়াল হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইন্তেকাল করলে তা ঘটেছিল ৮ রবিউল আউয়াল।
ওপরের আলোচনা থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, সফর মাসের শেষ বুধবার হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুস্থ হওয়া, গোসল করা এবং এ জন্য সাহাবিদের আনন্দিত হওয়া ও দান-সদকা করার কাহিনির কোনো ভিত্তি নেই।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনে অনেক আনন্দের দিন এসেছে। যখন তিনি আনন্দিত হযেছেন শোকরিয়া জ্ঞাপনের জন্য আল্লাহর দরবারে সিজদাবনত হয়েছেন। কিন্তু পরের বছর বা পরবর্তী কোনো সময় সেই দিনকে তারা বাৎসরিক আনন্দ দিবস হিসেবে উদযাপন করেননি। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশ বা সাহাবিদের কর্ম ছাড়া এরূপ কোনো দিন পালন করা কিংবা এ দিনগুলোতে বিশেষ ইবাদতকে বিশেষ সওয়াবের কারণ বলে মনে করার কোনো সুযোগ নেই।
উপরোক্ত বিষয় ছাড়াও অনেকেই সফর মাসকে অশুভ মনে করে থাকেন। ইসলামি শরিয়তে এরও কোনো ভিত্তি নেই। কোনো স্থান, সময়, বস্তু কিংবা কর্মকে অশুভ অথবা অমঙ্গলময় বলে মনে করা ইসলামি বিস্বাসের ঘোর পরিপন্থী। এটা একটি কুসংস্কার। প্রাচীন আরবের মানুষেরা জাহেলি যুগ থেকেই সফর মাসকে অশুভ ও বিপদাপদের মাস বলে বিশ্বাস করতো। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের এই বিশ্বাসের প্রতিবাদ করে বলেন, ‘ইসলামে কোনো অশুভ-অযাত্রা নেই। ’ -সহিহ বোখারি ও মুসলিম
এর পরও মানুষের মনে স্থান পায়, এই মাস বালা-মুসিবতের মাস হিসেবে। তবে মুহাদ্দিসরা এ বিষয়ে একমত যে, সফর মাসের সকল কথা ভিত্তিহীন মিথ্যা। বিভিন্ন জাল হাদিসে বলা হয়েছে, বুধবার অশুভ এবং যে কোনো মাসের শেষ বুধবার সবচেয়ে অশুভ। আর সফর মাস যেহেতু অশুভ; সেহেতু সফর মাসের শেষ বুধবার বছরের সবচেয়ে বেশি অশুভ দিন। এগুলোর সবই ভিত্তিহীন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ০২, ২০১৬
এমএইউ/