ঢাকা, শনিবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

৭১ এর শেষ যুদ্ধক্ষেত্র শিরোমণি, হয়নি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ

মাহবুবুর রহমান মুন্না, ব্যুরো এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১০ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০২৩
৭১ এর শেষ যুদ্ধক্ষেত্র শিরোমণি, হয়নি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ

খুলনা: খুলনার শিরোমণিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধের কারণে খুলনা শত্রুমুক্ত হয় একদিন পর ১৭ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও ঠিক ওই সময় খুলনার শিরোমণিতে একটি বৃহৎ প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেয় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনারা।

শিরোমণির এ যুদ্ধকে বলা হয় ‘ব্যাটল অব শিরোমণি’, যা কিনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর একমাত্র ট্যাংক যুদ্ধ। এটি খুলনা শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। পরে এ যুদ্ধের কাহিনী সিলেবাস আকারে কৌশল ভারত, পোল্যান্ডসহ ৩৫টি দেশের সেনাবাহিনীর ডিফেন্স কলেজে পড়ানো হয়।

১৯৭১ সালের মূলযুদ্ধ ও আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হয়েছিল যেখানে। স্বাধীনতার ৫২ বছর অতিবাহিত হলেও খুলনার শিরোমণির সেখানে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ হয়নি। স্বাধীনতার শেষ যুদ্ধক্ষেত্র শিরোমণিতেই একটা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হোক, যা আগামী প্রজন্মের জন্য ইতিহাস হয়ে থাকবে এটাই এ এলাকার মুক্তিযোদ্ধা তথা স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রাণের দাবি।

ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাধ্য হয়ে যশোর সেনানিবাস ছেড়ে খুলনাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনীর খুলনা সদর দপ্তরের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার মুহম্মদ হায়াত খান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটা বড় ব্রিগেড নিয়ে খুলনার শিরোমণি, আটরা, গিলেতলা, শ্যামগঞ্জ, তেলিগাতি এলাকার একাধিক স্থানে ক্যাম্প গড়ে তোলেন। এর মধ্যে জনশূন্য শিরোমণি কমান্ডার হায়াত খান সবচেয়ে বড় ক্যাম্প গড়েন। হায়াত খান তার সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ ব্রিগেড নিয়ে খুলনা শহরের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম এলাকাজুড়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। তাছাড়া আটরা থেকে শিরোমণি এলাকার যশোর রোডে ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন পুঁতে বিশেষ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রস্তুতি নেয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করেও কোনো সাড়া না পেয়ে এবং তাদের নীরবতা দেখে ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে ফুলতলার চৌদ্দ মাইলে অবস্থানরত মিত্রবাহিনীর মেজর মহেন্দ্র সিং ও মেজর গণির নেতৃত্বে একটা বড় কনভয় ১৪ ডিসেম্বর খুলনার দিকে রওনা করে। মিত্রবাহিনী খুলনার শিরোমণি এলাকার যুদ্ধক্ষেত্রে নিশানার মধ্যে পৌঁছালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিভিন্ন দিক থেকে তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়।  

অপরদিকে মিত্রবাহিনীর একটি ইউনিট ইস্টার্ন জুটমিল গেট এলাকা দিয়ে ভৈরব নদ পার হয়ে শিরোমণির ঠিক পূর্ব পাশে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে পশ্চিম পাশে পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশে গোলা ছুড়তে থাকেন। ওই সময় মেজর মঞ্জুর তার বাহিনীকে নিয়ে ১৫ ডিসেম্বর ও ১৬ ডিসেম্বর সারাদিন ধরে বিভিন্ন দিক থেকে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ করে পাকিস্তান বাহিনীকে শিরোমণি অবস্থানে ঘিরে ফেলেন। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করলেও হায়াত খান তা না মেনে তার বাহিনীকে নিয়ে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডো দলের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার হায়াত খানের নেতৃত্বাধীন সেই ট্যাংক রেজিমেন্ট এবং চার সহস্রারাধিক সৈন্য। ওই রাত থেকেই মেজর মঞ্জুরের নেতৃত্বে শুরু হয় সর্বাত্মক সম্মুখ সমর। সারারাত ধরে চলা যুদ্ধে প্রবল ক্ষয়ক্ষতির মুখে এক পর্যায়ে ১৭ ডিসেম্বর ভোরে পর্যুদস্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়। তখন বিজয়ী মিত্রবাহিনী-মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে শিরোমণি নসু খানের ইটভাটার কাছে পরাজিত পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করে। এ যুদ্ধটিকে বলা হয় ‘ব্যাটল অব শিরোমণি’। এ যুদ্ধে শিরোমণি বাজার, গিলাতলাসহ আশপাশের এলাকার ব্যাপক ক্ষতি হয়। প্রতিটি গাছ ও ভবনে শত শত গুলি ও শেলের আঘাতের চিহ্ন ১৯৮০-৮১ সাল পর্যন্ত দেখা গেছে। তা পরবর্তীকালে ওইসব গাছ-পালা ও ঘরবাড়ি দেখে মানুষ শিরোমণি যুদ্ধের ভয়াবহতা আন্দাজ করতে পারতেন। দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে শিরোমণির যুদ্ধ খুবই উল্লেখযোগ্য।

ওই যুদ্ধের স্মরণে বর্তমান সরকারের সময় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গিলেতলা সেনানিবাসের সামনে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১০ সালের ৪ আগস্ট খুলনা-যশোর রোডের গা ঘেঁষে গিলেতলায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলাম স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এটি নির্মাণে ৫৩ লাখ টাকা ব্যয় হয়। যেখানে মূলযুদ্ধ ও আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হয়েছিল, সেই স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ হয়নি। হয়েছে সেনা নিবাসের সামনে। যার কারণে মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতার শেষ যুদ্ধক্ষেত্র শিরোমণিতেই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছেন।

এ প্রসঙ্গে ওই যুদ্ধ অংশ নেওয়া খানজাহান আলী থানা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা স ম রেজওয়ান আলী বাংলানিউজকে বলেন, ১৯৭১ সালের যুদ্ধ ও আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হয়েছিল শিরোমণিতে। শিরোমণির সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছিলাম দীর্ঘদিন ধরে। তবে শুনেছি স্মৃতিস্তম্ভ হবে। শিরোমণিতে স্মৃতিস্তম্ভ হবে বলে ৬৫ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। যেটি হবে ৯৫ ফিট লম্বা ও ৬৫ ফিট চওড়া।

তবে সরকারের কোন দপ্তর থেকে এ কাজ বাস্তবায়ন করা হবে তা জানাতে পারেননি এ বীর মুক্তিযোদ্ধা।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৯ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০২৩
এমআরএম/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।