বান্দরবান: বান্দরবানে চিম্বুক এলাকার প্রায় ৯০টি ম্রো পাড়ায় তীব্র পানি সংকট দেখা দিয়েছে। বহুদিন ধরে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট হওয়ায় বাধ্য হয়েই ঝিরির নোংরা পানি পান করে জীবনধারণ করছেন তারা।
পানির সংকটের সমাধান না হলে পাড়া ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার কথা জানান ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দুই হাজার ফুট উপরে বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ের বিভিন্ন পাড়াতে শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকট লেগেইে থাকে। আর মার্চ থেকে মে এই তিন মাস যেন পানির কষ্ট আরও বেড়ে যায় ম্রো পাড়াগুলোতে।
কয়েক কিলোমিটার দুর্গম পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে ঝিরি থেকে খাবারের পানি সংগ্রহ করার অবিরাম চেষ্টা চালায় চিম্বুক পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত পরিবারগুলো। তবে পানির উৎস শুকিয়ে যাওয়ায় নিদারুণ পানির কষ্টে এলাকার বাসিন্দারা এখন মানবেতর জীবনধারণ করছে। বিশুদ্ধ পানির কষ্টে এখন দিনযাপন করছে চিম্বুক পাহাড় এলাকার রামড়ী পাড়া, ম্রলং পাড়া, বাগান পাড়া, বাইটা পাড়া, হেডম্যান পাড়া, যামিনী পাড়াসহ ৯০টি পাড়ার বাসিন্দারা।
সম্প্রতি চিম্বুক পাহাড়ের আশপাশে সরেজমিনে দেখা যায়, সব পানির উৎস শুকিয়ে গেছে। কোথাও চলতে চলতে ঝিরির শেষ মাথায় গর্তে অল্প পানি জমা আছে, সেখান থেকেই বিভিন্ন পাড়ার বাসিন্দারা ময়লাযুক্ত পানি সংগ্রহ করছে।
জেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে ম্রোলং পাড়া, সেই পাড়ার বাসিন্দা রাংমে ম্রো বাংলানিউজকে বলেন, ঝিরি থেকে পানি আনতে আসা-যাওয়ায় দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। ভোর ৪টায় পানি আনতে গিয়ে সকাল ৬টার সময় পাড়ায় ফিরে আসা যায়। দুই মগ পানি নেওয়ার পর আট মিনিট থেকে দশ মিনিট পানির জন্য অপেক্ষা করতে হয়। বয়স্ক নারীরা রাত ২/৩টার সময় পানি আনতে ঝিরিতে যায়।
তিনি আরও বলেন, আমাদের পাড়ায় প্রচুর পানির কষ্ট। পানির কোনো ভালো উৎস নেই, প্রাকৃতিকভাবে ঝিরিতে কিছুটা পানি পেতাম তবে গরমের কারণে ঝিরিও শুকিয়ে গেছে।
রামরীপাড়ার বাসিন্দা পানলা ম্রো বাংলানিউজকে বলেন, পানির অভাবে দুই থেকে তিন মাস পর্যন্ত নিয়মিত গোসল করা যায় না, যারা কাজে যান যেখানে পানি পান এবং সেখানে গোসল করে ফেরার সময় অল্প পানি পেলে সেটাই বাড়িতে নিয়ে আসেন।
রামরীপাড়ার বাসিন্দা প্রেনপ্রে ম্রো বাংলানিউজকে বলেন, চিম্বুক এলাকায় কম হলেও ১০ হাজার মানুষ বসবাস করে। কিন্তু তারা সুপেয় পানি না পেয়ে ময়লা পানি পান করে সারাবছরই নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। এ কারণে অনেকেই মারাও যাচ্ছে।
তিনি বাংলানিউজকে আরও বলেন, আমরা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি সুদৃষ্টি দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছি।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছে, নির্বিচারে পাহাড় থেকে বৃক্ষ ও পাথর নিধনের ফলে পাহাড়ের পানির উৎসগুলো দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আর শুষ্ক মৌসুম এলে এর খেসারত দিতে হয়িএই এলাকার জনগণকে।
ম্রো ভাষার লেখক ও গবেষক ইয়াং ঙান ম্রো বাংলানিউজকে বলেন, বান্দরবানের দুর্গম গ্রামগুলোতে অনেক পানির কষ্ট। বিশেষ করে চিম্বুক পাহাড়ের আশপাশের ম্রো জনগোষ্ঠী এখন পানির অভাবে কষ্ট পাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, একসময় ঝিরিতে প্রচুর পানি থাকলেও গত কয়েক বছর ধরে পানির অভাবে সবারই কষ্ট বাড়ছে।
তিনি বাংলানিউজকে আরও বলেন, এভাবে চলতে থাকলে আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্য শুধু পানির অভাবে ম্রো জনগোষ্ঠী চিম্বুক এলাকা থেকে অন্য জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হবে।
বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য সিং ইয়ং খুমী বলেন, বনাঞ্চল ধ্বংস, ঝিরির পাথর উত্তোলন করে পানির উৎস ধ্বংস করার কারণে প্রতিবছর চিম্বুক এলাকার প্রায় ৯০টি পাড়ার ম্রো সম্প্রদায় বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভোগে। পানির অভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজ ব্যাহত হওয়ায় পাশাপাশি ফল-ফলাদি উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
রামরী পাড়ার কারবারী (পাড়া প্রধান) মেনরুম ম্রো বাংলানিউজকে বলেন, চিম্বুক এলাকার মানুষের এখন সবচেয়ে বড় কষ্ট হলো পানি। নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার ও খাবার জন্য কোথাও পানি নেই। ফল বাগানে দেওয়ার মত পানিও নেই।
সূত্রে জানা যায়, বিশুদ্ধ পানির অভাবে ২০২১ সালে বান্দরবানের আলীকদমের কুরুকপাতা ইউনিয়নে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে ম্রো জনগোষ্ঠীর সাতজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। ২০২২ সালে থানচি উপজেলায় ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে মারা যায় আরও আটজন, এছাড়া নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল অসংখ্য পাড়াবাসী।
এদিকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বান্দরবানের নির্বাহী প্রকৌশলী শর্মিষ্টা আচার্য্য বাংলানিউজকে বলেন, দুর্গম এলাকায় পাথরের কারণে টিউবওয়েল স্থাপন করা যায় না, সেখানে রিংওয়েল স্থাপন এবং যেসব ঝিরিতে শুষ্ক মৌসুমেও পানি থাকে সেখানে বরাদ্দ সাপেক্ষে জিএফএস পদ্ধতিতে পানি সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
নির্বাহী প্রকৌশলী বাংলানিউজকে আরও বলেন, চিম্বুক এলাকাসহ বিভিন্ন দুর্গম এলাকার জন্য নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০২৩
আরএ