নাটোর: নিজের ইচ্ছা পূরণে ২৫ বছর পরে ৪০ বছর বয়সে আবার পড়াশোনা শুরু করেছেন চায়ের দোকানদার আব্দুল হান্নান। সেই ইচ্ছা বাস্তবে রূপ দিতে এ বছর নাটোরের লালপুর থেকে মেয়ে হালিমা খাতুনের (১৫) সঙ্গে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন তিনি।
রোববার (৩০ এপ্রিল) উপজেলার লালপুর থেকে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন তিনি।
২৫ বছর আগে ১৯৯৮ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন নাটোরের লালপুর উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল হান্নান। কিন্তু পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারেননি। আর পড়ালেখা হয়ে ওঠেনি। সেসময় বাবার চায়ের দোকানে ব্যবসা শুরু করেন। চায়ের দোকানের ব্যবসার পাশাপাশি নিজস্ব জমিজমা চাষ করতেন তিনি। সেই দোকানের আয় ও জমিজমা চাষ করে স্ত্রী, দুই ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে সংসার জীবনে বেশ ভালো আছেন।
দুই যুগ আগে এসএসসি পাস করতে না পারার আক্ষেপ ঘোচাতে এ বয়সে আবারও পড়ালেখা শুরু করেন আব্দুল হান্নান। ভর্তি হন রুইগাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের ভোকেশনাল শাখায়। আর একমাত্র মেয়ে হালিমা খাতুন নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস হাইস্কুলের মানবিক শাখার শিক্ষার্থী। এবার বাবা-মেয়ে এক সঙ্গে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন।
মেয়ে লালপুর শ্রীসুন্দরী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে আর বাবা আব্দুল হান্নান লালপুর থানা বালিকা কেন্দ্রে পরীক্ষা দিচ্ছেন। তাদের দুইজনের পরীক্ষা ভালো হচ্ছে এবং ফলাফলও ভালো হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। আর বাবা-মেয়ের এক সঙ্গে পরীক্ষা দেওয়া নিয়ে সাধারণ মানুষও বেশ উপভোগ করছেন। তাদের উৎসাহ ও সাধুবাদ জানাচ্ছেন অনেকেই।
পরীক্ষার্থী আব্দুল হান্নান বাংলানিউজকে জানান, ১৯৯৮ সালে তিনি নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস হাইস্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অকৃতকার্য হন। এরপর আর পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়া তার সম্ভব হয়নি। এরপর জীবন জীবিকার প্রয়োজনে গোপালপুর রেলগেটে শুরু করেন চায়ের দোকানদারি। সেই দোকানের আয় ও জমিজমা চাষ করে স্ত্রী, দুই ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে সংসার জীবনে বেশ ভালো আছেন।
এই বয়সে আবারও পড়াশোনার ইচ্ছেটুকু কীভাবে জাগলো এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ছাত্র জীবনের এসএসসি পাসের প্রবল ইচ্ছাটা দিনে দিনে তার মধ্যে প্রবল থেকে প্রবলতর হতে থাকে। এজন্য গত ২০২১ সালে পরিবারের কাউকে না জানিয়ে তিনি উপজেলার রুইগাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম (ভোকেশনাল) শ্রেণিতে ভর্তি হন। আর বই পুস্তক কিনে দোকানেই রেখে ব্যবসার ফাঁকে ফাঁকে পড়ালেখা করতে থাকেন।
তবে দোকানে ব্যস্ততার কারণে স্কুলের ক্লাশে যাওয়া সম্ভব হয়নি। পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেন এবং ওই স্কুলে ফরম ফিলাপ করেন। বিষয়টি প্রথমে পরিবারের লোকজনের কাছে অজানা ছিল। ফরম পূরণের সময় বিষয়টি জানাজানি হয়। শেষ পর্যন্ত এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। মেয়ে হালিমাও পরীক্ষা দিচ্ছে। ফলাফল ভালো হলে আরও পড়ালেখা করার ইচ্ছে আছে তার। প্রয়োজনে বাবা-মেয়ে এক সঙ্গে কলেজে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা করবেন এমনটাই ইঙ্গিত দিলেন চা বিক্রেতা আব্দুল হান্নান।
অপরদিকে মেয়ে হালিমা খাতুন বাংলানিউজকে জানান, বাবা তার সঙ্গে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন এতে খুব ভালো লাগছে। বাবার সঙ্গে পরীক্ষা দেওয়ার অনুভূতিই আলাদা। বাবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ দেখে অন্যরা পড়াশুনায় অনুপ্রাণিত হবে। তাই বাবার সঙ্গে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে গর্ববোধ করছি।
পাশাপাশি আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করি-আমার বাবা যেন ভালো রেজাল্ট করেন। ইচ্ছে আছে বাবার সঙ্গে কলেজে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাবো। গর্ব করে বলতে পারবো বাবার সঙ্গে পরীক্ষা দিয়ে এসএসসি পাস করেছি। আর যদি এক সঙ্গে আরও পড়ালেখা করতে পারি, তাহলে বলতে পারবো আমার বাবা শিক্ষিত। অন্যদের তুলনায় একটু আলাদা পরিচয় হবে আমাদের।
লালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শামীমা সুলতানা বাংলানিউজকে বলেন, শিক্ষার কোনো বয়স নেই, তার উদাহরণ বয়োজ্যেষ্ঠ পরীক্ষার্থী আব্দুল হান্নান। কেবল ইচ্ছাশক্তি, মনোবল আর একটু প্রচেষ্টা তিনি লেখাপড়া শুরু করেছেন। আবার তার মেয়েও এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। এতে অন্যরা শিক্ষা গ্রহণে অনুপ্রাণিত হবে। এটা একটা আনন্দের খবর। শুধু তাই নয়, এটা সমাজ ও দেশের জন্য শুভ ইঙ্গিত। তাদের বাবা-মেয়ের জন্য শুভ কামনা রইলো।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০২৩
আরএ