চাঁদপুর: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযান কম হওয়ায় চাঁদপুরের দুই সীমান্ত উপজেলা মতলব দক্ষিণ ও কচুয়ায় মাদক কারবারিদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে।
বিশেষ করে মতলবের নায়েরগাঁও বাজারের মাদক কারবারিরা এখন সক্রিয় সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে।
এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছেন নারীসহ বহু কারবারি। আটক হলেও তারা ছাড়া পেয়ে একই কারবারে যুক্ত হচ্ছেন।
ঘরে ঘরে মাদকসেবী ও বিক্রেতাদের কারণে অতিষ্ঠ জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয়রা। স্থানীয় সংসদ সদস্য বলছেন, মাদকে যুক্তরা রাজনৈতিক পরিচয় কিংবা যত বড় শক্তিশালী হউক না কেন ছাড় দেওয়া হবে না।
সরেজমিন মতলব দক্ষিণ উপজেলার নায়েরগাঁও বাজার ও কুমিল্লার দাউদকান্দি ব্রিজ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে সবকিছুই উন্মুক্ত। এখানে কোনো চেক পোস্টের দেখা মেলেনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়িও নেই।
এমন পরিস্থিতিতেই কচুয়া ও দাউদকান্দি থেকে শত শত যানবাহন প্রবেশ করছে। এই সুযোগে যাত্রীবেশে প্রবেশ করছে মাদক কারবারিরা। এখান থেকে নন্দলালপুর নদী পার হয়ে খুব সহজেই চলে যাচ্ছে মতলব উত্তর এবং ঢাকায়। রাতে টহল পুলিশ এলেও দিনের বেলায় উন্মুক্ত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নায়েরগাঁও দক্ষিণ ইউনিয়নের নায়েরগাঁও বাজার হচ্ছে মাদক কেনাবেচার বড় আস্তানা। সীমান্ত এই বাজারে মাদকবিক্রেতাদের নেতৃত্ব দেন রাজিয়া বেগম (৫৫) নামের এক নারী ও তার পরিবারের সদস্যরা। সর্বশেষ গত ২৩ জুলাই ২৮০০ পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হন রাজিয়া বেগম (৫৫) ও দাউদকান্দির আব্দুল খালেক (৪৫)। তারা জামিনে এসে আবারও একই কারবারে জড়িত হন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নায়েরগাঁও বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, সাবেক ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলামের স্ত্রী রাজিয়া তার ছেলে জাহাঙ্গীর আলম ও ডালিম প্রধানকে দিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ মাদকের রমরমা ব্যবসা করে আসছেন। দাউদকান্দি সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় মাদকের একটি বিশাল সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে ওই পরিবার। শুধু তাই নয় নায়েরগাঁও এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও মাদক ব্যবসা জমিয়ে তোলায় এক নামে সবাই চেনে রাজিয়াকে। প্রতিবাদ করার সাহসও পায়না কেউ। কেউ প্রতিবাদ করলে উল্টো তাদেরকে নানাভাবে হয়রানি করার চেষ্টা করে রাজিয়া পরিবার।
মতলব দক্ষিণ থানা ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, রাজিয়ার ছেলে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে মতলব, দাউদকান্দি, যাত্রাবাড়ী ও রামপুরা থানায় ৯টি ও ডালিমের বিরুদ্ধে মতলব দক্ষিণ থানায় ১৫টি ও দাউদকান্দি থানায় ২টি মাদক মামলা রয়েছে।
এসব বিষয়ে রাজিয়া সুলতানার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, আমি নায়েরগাঁও ইউনিয়ন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। যারা আমার বিষয়ে এসব কথা বলছে তারা মানুষের মধ্যে পড়ে না। আমার দুই বিয়ে হয়েছে। জাহাঙ্গীর ও ডালিম আগের পরিবারের সন্তান। তারা আমার কাছে থাকে না, মাঝেমধ্যে আসে। তাদের বিষয়ে এর চাইতে বেশি কিছু জানি না। আমাকে ষড়যন্ত্র করে মাদক দিয়ে আটক করা হয়। উপরের নির্দেশ ছাড়া এর বেশি আর বলতে চাই না।
নায়েরগাঁও বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মাসুদ রানা বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে বাজারের ব্যবসায়ীরা প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। যারা এসব ব্যবসা করে তাদেরকে কয়েকবার পুলিশ আটকও করেছে।
ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড ইউপি সদস্য আলাউদ্দিন বলেন, রাজিয়ার পরিবারের সব সদস্য মাদকে জড়িত। তাদের আচরণ খুবই খারাপ। আমি নিজ উদ্যোগে মাদককারবারিদের তালিকা থানায় দিয়েছি। পুলিশ আটক করলেও জামিনে এসে আবারও জড়িয়ে পড়ছে। বাজার এলাকায় ঘরে ঘরে মাদক। সন্তানদের নিয়ে বসবাস কঠিন হয়ে পড়েছে।
ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল মামুন মৃধা বলেন, নায়েরগাঁও বাজার এলাকা উন্মুক্ত। সীমান্ত এই অঞ্চলে হাজার হাজার মানুষ চলাচল করে। মাদক নিয়ে কে প্রবেশ করে তা বলা অসম্ভব। মাদকের বিষয়ে আমার কাছে কোনো ছাড় নেই। আমার আপন ভাই যদি মাদক নিয়ে আটক হয়, তাহলেও সুপারিশ করব না।
মতলব দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রিপন বালা জানান, রাজিয়া ও তার দুই ছেলের বিরুদ্ধে মতলব দক্ষিণ ও অন্যান্য থানায় মাদকের অনেক মামলা রয়েছে। তবে ওইসব মামলায় তারা জামিনে আছেন। তারা যদি আবারও মাদক কারবার করে এবং হাতেনাতে পাওয়া যায় কোনো ছাড় দেয়া হবে না। আমাদের মাদকবিরোধী অভিযান অব্যাহত।
চাঁদপুর জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে কথা হয় নায়েরগাঁও বাজার মাদকের ভয়াবহ অবস্থা নিয়ে।
তিনি বলেন, আমি নতুন এসেছি। গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা নিয়ে অবশ্যই অভিযান পরিচালনা করব।
চাঁদপুর-২ (মতলব দক্ষিণ ও মতলব উত্তর) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট নুরুল আমিন রুহুলকে সীমান্ত এলাকা নায়েরগাঁও বাজারের মাদকের ভয়াবহতার চিত্র ও রাজিয়া পরিবারের বিষয়ে অবগত করা হয়।
তিনি বলেন, মাদকের বিষয়ে আমি প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করি। রাজিয়া নামে ওই নারীকে কারা নেত্রী বানিয়েছে আপনারা খোঁজ নিলে জানতে পারবেন। তার সঙ্গে কাদের ছবি আছে! মাদকে জড়িত যত শক্তিশালী ব্যক্তি হউক না কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
তিনি আরও বলেন, বিগত ৫ বছরে আমি এই ধরনের লোকদেরকে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করি নাই। মাদকের সঙ্গে জড়িতরা পরিবার, সমাজ ও দেশের শত্রু। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হওয়ার জন্য নির্দেশনা দেব। সাংবাদিকের কলম ও প্রশাসন কাজ করলে অবশ্যই মাদকে জড়িতরা আইনের আওতায় আসবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০২৩
এসএএইচ