ঢাকা: মহসিন আশরাফ মতিঝিলে একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন। যাতায়াত করতেন নিজের গাড়িতে।
মহসীন বলেন, আমরা এখন এমন পরিবহন ব্যবস্থা পেয়েছি যা মতিঝিলকে আবার কার্যকর করবে। যোগাযোগের বাধার কারণে ব্যাংকপাড়া নামে পরিচিত মতিঝিল থেকে অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় চলে গেছে। মেট্রোরেল মতিঝিলের সেই পুরনো জৌলুস ফিরিয়ে আনবে।
আনন্দ-উচ্ছ্বাস শুধু মহসিন আশরাফের একার নয়! আবেগ প্রকাশ করেছেন মেট্রোরেলে যাতায়াতকারী বহু মানুষ।
আসগর আলী নামে এক যাত্রী বাংলানিউজকে বলেন, মতিঝিলে যেতে পথে পথে জ্যাম; ভ্যাপসা গরমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কে বসে থাকতে হতো। কাজীপাড়া, শ্যাওড়াপাড়া, আইডিবি, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বাংলমোটর- এক কথায় পুরো সড়কে জ্যাম। এখন সেই দূরত্ব মাত্র আধ ঘণ্টায় শেষ হচ্ছে। অসাধারণ ও আধুনিক মানের সেবা পাওয়া যাচ্ছে স্টেশনগুলো। এক স্টেশন থেকে আরেকটিতে যেতে কোনো বাধা নেই। অপেক্ষা, টিকিট কাটা, মেট্রোয় ওঠা; থেকে নামা সব ক্ষেত্রে আধুনিকতার ছোঁয়া। মনে হচ্ছে না বাংলাদেশের কোনো স্থাপনায় উঠেছি!
মেট্রোরেলের ভাড়া সাধারণ গণপরিবহনের চেয়ে একটু বেশি। যদিও সময় কম লাগা, আনন্দের ভ্রমণ, নিরাপত্তা ও স্ট্যান্ডার্ড ফ্যাসিলিটির কারণে সেটি গায়ে লাগছে না। আগামীতে দেখবো অনেকেই নিজ নিজ গাড়ি ছেড়ে মেট্রোয় চলাচল করবে। মোটরসাইকেলের নির্ভরতা কমবে, বলেন আসগর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি ডিরেক্টর (ডিডি) ইমরুল রানা মোটরসাইকেলে যাতায়াত করেন। বাংলানিউজের সঙ্গে কথায় কথায় তিনি বলেছেন, গত রোববার থেকে আমি মেট্রোরেলে যাতায়াত করছি। এখন থেকে এ বাহনেই যাতায়াতের চিন্তা করছি।
গত ৫ নভেম্বর মেট্রোরেল চলাচল শুরুর দিন থেকে দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচি চলছে। এ কারণে অফিসমুখি মানুষ যতটা ভালো লাগা থেকে মেট্রো ভ্রমণ করছেন, তার চেয়ে বেশি করছেন বাধ্য হয়ে। যাত্রীরা জানান, পরিচ্ছন্ন, সময় সাশ্রয়ী, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ হকারের হাঁক-ডাক ও অবাঞ্ছিত লোকজন মুক্ত হওয়ায় সাধারণ মানুষ মেট্রেরেলে যাতায়াতের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। এর প্রভাবও চোখে পড়ার মতো। মতিঝিলের অফিস আঙিনাগুলোয় মানুষের রব বেড়েছে। আগের চেয়ে গাড়ির সংখ্যা কমেছে। হরতাল-অবরোধ উঠে গেলে আগের তুলনায় গণপরিবহনের সংখ্যাও কমে যাবে। এখন বেলা ১১টা পর্যন্ত মেট্রো সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে, আগামীতে এটি আরও বাড়বে।
বর্তমানে উত্তরা, বৃহত্তর মিরপুর, ফার্মগেট-কারওয়ান বাজারের আশপাশের মানুষ মেট্রো ব্যবহার করতে পারছে। বিমানবন্দর-কমলাপুর এক্সপ্রেসওয়ে চালু হলে মতিঝিলের চেহারাই বদলে যাবে বলে মনে করেন রাজধানীর বাসিন্দারা। এতে করে মতিঝিল বার্ধক্যে উপনীত হয়েছে বলে যারা বিভিন্ন অফিস সরিয়ে নিচ্ছিল, সেটি কমে যাবে।
মতিঝিলের যাওয়ার ক্ষেত্রে সড়কে যানজট যতটা সংকট তৈরি করে তারচেয়ে বেশি দায়ী মতিঝিলের বহুতল ভবনে প্রয়োজন মতো পার্কিংয়ের ব্যবস্থা না থাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় একটি পার্কিং থাকলেও অন্যান্যগুলোয় নেই। মোটরসাইকেলের জন্য বিশেষ ইয়ার্ড তৈরি করেও লাভ হচ্ছে না।
সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কার পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই। ফলে রাস্তায় গাড়ি পার্ক করতে হচ্ছে। মতিঝিলের সাথে মেট্রোরেল ও কমলাপুরের সাথে এক্সপ্রেসওয়ের পুরোপুরি সংযোগ হয়ে গেলে সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি ব্যাংকপাড়ায় পরিবহন রাখার জায়গা বাড়বে। এতে করে মতিঝিল যৌবন ফিরে পাবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা।
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস’র গবেষণা পরিচালক ড. জায়েদ বখত বলেন, এমন পরিকল্পনা থেকেই সরকার এ ধরণের প্রকল্পগুলো গ্রহণ করেছে। নতুন নতুন যেসব এলাকায় সুরম্য অফিস, প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে সেগুলোর পাশাপাশি মতিঝিল যাতে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে এ জন্য সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। নতুন শহর পূর্বাচলের উপযোগী যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। মিরপুরের উত্তরে উত্তরার সাথেও মেট্রোরেলের সংযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, দেশের উন্নয়ন হচ্ছে। তার সাথে সম্পর্ক রেখে যোগাযোগ ব্যবস্থারও উন্নতি হচ্ছে। যোগাযোগের গ্রাফিক্যাল ডিস্ট্রিবিউশনও অনেক পরিবর্তন হবে।
মতিঝিলের অন্যতম সমস্যা হচ্ছে ফুটপাতের হকার। এ সব হকার ছোট ছোট ব্যবসার মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করলেও সমানভাবে যানজট ও নিরাপদ চলাচলের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। মেট্রোরেলের কারণে হকার সরে যাচ্ছে। আগামীতে মতিঝিলের প্রধান প্রধান সড়কগুলোও হকারমুক্ত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪২ ঘণ্টা, নভেম্বর ৬, ২০২৩
জেডএ/এমজে