ঢাকা: দিনাজপুরের বিরল পৌরসভার কম্পিউটার অপারেটর মো. আব্দুর রশিদ। সোহেল চন্দ্র নামে আরেক ব্যক্তি বিরলের ১০ নং রাণীপুকুর ইউনিয়ন পরিষদের কম্পিউটার অপারেটর।
এই কাজের জন্য তারা দুইজন একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এর মধ্যে ভুয়া জন্মনিবন্ধন করার চাহিদা সরবরাহকারী হিসেবে তাদের সঙ্গে যোগ দেন মোস্তাফিজুর রহমান। বাগেরহাট থেকে শহিদুল ইসলাম মুন্না এবং নারায়ণগঞ্জ থেকে রাসেল খান ভুয়া জন্ম নিবন্ধন তৈরির লোক সরবরাহ করতেন। চক্রের এই পাঁচ সদস্য অর্থের বিনিময়ে স্থানীয় নাগরিকদের পাশাপাশি কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গা নাগরিকদের বিরলের অধিবাসী দেখিয়ে ভুয়া জন্ম নিবন্ধন সনদ সরবরাহের কাজ করে আসছিলেন।
এসব সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা এবং গোয়েন্দা তথ্যে গত ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাগেরহাট, দিনাজপুর এবং নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের অর্গানাইজড অ্যান্ড ওয়েব বেইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম। অভিযানে গ্রেপ্তার আসামিদের কাছ থেকে তাদের ব্যবহৃত পাঁচটি মোবাইল ফোন, আটটি সিম জব্দ করা হয়।
গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, এই চক্রের সহায়তায় কক্সবাজারে আশ্রিত অনেক রোহিঙ্গা (মিয়ানমারের নাগরিক) ভুয়া জন্মসনদ তৈরি করে তা দিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট তৈরি করে বাংলাদেশের নাগরিক হচ্ছেন।
এ বিষয়ে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের অর্গানাইজড অ্যান্ড ওয়েব বেইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. সাইফুর রহমান আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, ৯ ফেব্রুয়ারি অনলাইনে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড (সাইবার ক্রাইম) নজরদারি করার সময় এই বিষয়গুলো আমাদের নজরে আসে। তারপর আমরা তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ও ম্যানুয়ালি কাজ করা শুরু করি। পরে চক্রের সদস্যদের শনাক্ত করে পাঁচ আসামিকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তিনি বলেন, এই চক্রের সদস্যরা বিরল পৌরসভার ও ইউনিয়ন পরিষদের মেয়র/চেয়ারম্যান/ইউনিয়ন সচিবের আইডি ব্যবহার করে রোহিঙ্গাসহ হাজার হাজার অপরাধীর ভুয়া জন্ম নিবন্ধন তৈরি করে আসছিলেন। এজন্য তারা পাঁচ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত করে নিতেন।
সাইফুর রহমান আজাদ বলেন, চক্রের হোতা রশিদ ও সোহেল। তারা যথাক্রমে বিরল পৌরসভার ও রাণীপুকুর ইউনিয়ন পরিষদের কম্পিউটার অপারেটর। তাদের যোগসাজশে এই ভুয়া জন্ম নিবন্ধন তৈরি হতো। আর গ্রেপ্তার আসামি শহিদুল ইসলাম মুন্না, রাসেল খান ও মোস্তাফিজুর লোক সরবরাহ করতেন। এ কাজে তারা সবাই আনুপাতিক হারে লাভ ভাগাভাগি করে নিতেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার চক্রের সদস্যরা জানান, কুষ্টিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের অন্যান্য পৌরসভা ও ইউনিয়নে তাদের লোকজন রয়েছে। যারা পাঁচ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে হাজার হাজার মানুষের ভুয়া জন্ম নিবন্ধন করে দিয়েছে।
আসামিদের ফোন পর্যালোচনা করে কললিস্ট, এসএমএস লিস্ট, নাম্বার টু এনআইডি, এনআইডি টু নাম্বার, লাঞ্চ কল লোকেশন, রেডিও লোকেশন, নগদ/বিকাশ, এনআইডি সার্ভার কপি, এনআইডি (সাইন কপি), সার্টিফিকেট (সাইন কপি), জন্ম- নিবন্ধন (সাইন কপি)-সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহের কাজে ব্যবহৃত হয় বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ মেলে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এসব ভুয়া জন্ম নিবন্ধন ব্যবহার করে অনেক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অবৈধভাবে দেশের নাগরিক হয়ে যাচ্ছে। অনেক অপরাধী অপরাধ করে নিজ এলাকার বাইরে আরেকটি জন্ম নিবন্ধন করে পরিচয় গোপন করে নতুন নতুন অপরাধ শুরু করছে। অনেকে ভুয়া পাসপোর্ট তৈরিতে এই জন্ম নিবন্ধন ব্যবহার করেছে। যাতে ব্যাংক ঋণ ও অনলাইন অপরাধে পুলিশকে ফাঁকি দিতে পারে। ভুয়া জন্ম নিবন্ধন ব্যবহার করে নতুন জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করা হচ্ছে। এসব জন্ম নিবন্ধন দিয়ে অনেক দাগী/কুখ্যাত খুনি, ডাকাত এবং রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধী চক্র নিজেদের পরিচয় গোপন করে ফেলতে সক্ষম হয় অথবা নতুন পরিচয়ে আবার অপরাধ শুরু করতে পারে।
এডিসি মো. সাইফুর রহমান আজাদ বলেন, গ্রেপ্তার আসামিদের মধ্যে দুজন কম্পিউটার অপারেটর, একজন স্থানীয় একটি গার্মেন্টসে এবং অপর দুজন পড়াশোনার পাশাপাশি ছোটখাট কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ভুয়া জন্ম নিবন্ধন সনদ তৈরি, বিশেষত রোহিঙ্গাদের জন্ম নিবন্ধন সনদ তৈরিতে ব্যাপক লাভ দেখে তারা এই অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। যেহেতু রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি নাগরিক নন এবং স্থানীয় নাগরিক পরিচিতির অভাবে বিভিন্ন নাগরিক সুবিধাপ্রাপ্তিতে তাদের অ্যাকসেস নেই, সেহেতু বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে ভুয়া নিবন্ধন তাদের জন্য সুবিধাজনক হওয়ায় তারা এই আসামিদের মাধ্যমে ভুয়া জন্ম নিবন্ধন সনদ তৈরি করে নিয়েছেন। আর এতে আসামিরাও আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে।
সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ
সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, দেশ দিন দিন ডিজিটালাইজড হচ্ছে। ডিজিটাল প্লাটফর্মে প্রতিনিয়ত তথ্য, উপাত্ত এবং অর্থ লেনদেন বাড়ছে। যার ফলে জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচপত্র প্রত্যেকের জন্য আবশ্যক হচ্ছে। তাই ব্যক্তিগত তথ্য, উপাত্ত এবং অর্থের লেনদেনে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা এবং সুরক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য সাধারণ মানুষের ডিজিটাল শিক্ষা এবং সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি) এ বিষয়ে ব্যাপক কাজ করে চলেছে। ডিবি দেশের জনগণের ডিজিটাল সেবা গ্রহণে সংগঠিত অপরাধের তথ্য সংগ্রহ, নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো ব্যবহারকারী সবাইকে তাদের আইডি পাসওয়ার্ড অধস্তনদের কাছে দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে জানিয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, শক্তিশালী আইটি সল্যুশন টিম এবং ইক্যুইপেমন্ট ব্যবহার করতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্র/জন্ম নিবন্ধন সার্ভারসহ গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামোতে দুর্বলতা থাকলে দ্রুত সমাধানে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। যথাযথ কর্তৃপক্ষ ছাড়া ভুয়া জন্ম নিবন্ধন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। নিবন্ধনকারী কর্তপক্ষের মনিটরিং জোরদার করা জরুরি। এমন কোনো চক্রের সন্ধান পেলে দ্রুত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবগত করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ২০০১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২৪
এসজেএ/এইচএ/