ঢাকা: ঈদযাত্রায় ঢাকা অঞ্চল থেকে এক কোটি ৬০ লাখ মানুষের বাড়ি ফেরায় ৯৮৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হবে। ৩ থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকা থেকে দেশের সড়ক, রেল, নৌ ও আকাশপথে ঈদযাত্রা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ শেষে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি এমন দাবি করেছে।
সংগঠনের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বাসভাড়া নির্ধারণের শর্তে বাসের চালক, সহকারী ও ভাড়া আদায়কারীর দুই ঈদে দুটি ঈদ বোনাস প্রতিদিনের আদায়কৃত ভাড়ায় ধার্য থাকলেও তা কার্যকর না করায় কিছু অসাধু বাসমালিক ও চালক এসবের তোয়াক্কা না করে এবারের ঈদে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্যে মেতে উঠেছেন।
যাত্রীরা জানাচ্ছেন, ভিজিল্যান্স টিমের সদস্যদের সামনে এমন ভাড়া নৈরাজ্য চললেও তারা দেখেও না দেখার ভান করে আছেন। তাদেরকে জানিয়ে আর কী লাভ হবে?
যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এবারের ঈদে সবচেয়ে বেশি যাত্রী নৌ-পথে পরিবহন করা হবে। ঢাকার সদরঘাট ও নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরসহ বিভিন্ন ঘাট দিয়ে প্রায় ৬০ লাখ যাত্রী দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যাবেন। যাত্রীপ্রতি গড়ে ৫০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত শ্রেণিভেদে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। গড়ে ২০০ টাকা হারে বাড়তি ভাড়া আদায় হলে ঈদের আগে এ যাত্রীদের ১২০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হবে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, রাজধানীতে চলাচলকারী সিএনজিচালিত অটোরিকশা ঈদকে কেন্দ্র করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য মেতে উঠেছে। ঈদে কেনাকাটা, বিভিন্ন টার্মিনালে যাতায়াতের পাশাপাশি দৈনন্দিন নানা কাজে এসব অটো ব্যবহার করতে গিয়ে প্রত্যেক যাত্রীকে গড়ে প্রতি ট্রিপে ২০০ টাকা হারে বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। ঈদের আগে রাজধানীতে চলাচল করা ২৫ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশায় প্রায় ৭০ লাখ ট্রিপে যাত্রীদের ১৪০ কোটি টাকার বেশি বাড়তি ভাড়া গুনতে হবে।
ইজিবাইক, মোটরচালিত রিকশা, প্যাডেলচালিত রিকশা ঈদ বকশিসের নামে যাত্রীপ্রতি গড়ে ২০ টাকা হারে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতি মনে করে, রাজধানীতে চলাচল করা প্রায় ১০ লাখ ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশা, প্যাডেলচালিত রিকশায় ১৪ কোটি ট্রিপে যাত্রীদের ২৮০ কোটি টাকা বাড়তি ভাড়া গুনতে হবে।
লেগুনা, দুরন্ত, দিগন্ত নানা নামে পরিচিত রাজধানীতে চলাচল করা সাত হাজার হিউম্যান হলারে ঈদের আগে প্রায় ৮০ লাখ ট্রিপে ঈদ বকশিসের নামে যাত্রীদের গড়ে প্রায় ২০ টাকা ভাড়া বাড়তি দিতে হবে। সেই হিসেবে ঢাকার লেগুনায় কেবল ১৬ কোটি টাকার বেশি বাড়তি ভাড়া আদায় হবে।
এবারের ঈদে দীর্ঘ ছুটির কারণে ঢাকা থেকে প্রাইভেটকার, জিপ ও মাইক্রোবাসে প্রায় ৩০ লাখ যাত্রীর যাতায়াত ছচ্ছে। এসব যানবাহনে ৫০ শতাংশ যাত্রী নিজেদের পরিবহন ব্যবহার করলেও ১৫ লাখ যাত্রীকে ভাড়ায় চালিত যানবাহনে ঈদে বাড়ি যেতে হচ্ছে। এতে তাদের ট্রিপপ্রতি গড়ে সাড়ে তিন হাজার টাকা হারে অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হচ্ছে। সেই হিসাবে এসব পরিবহন ব্যবহারকারী যাত্রীদের ১১২ কোটি টাকা বাড়তি ভাড়া গুনতে হবে।
এবারের ঈদে ঢাকা থেকে দূরপাল্লার রুটে ৩০ লাখ যাত্রীর যাতায়াতে যাত্রীপ্রতি গড়ে ৩০০ টাকা হারে বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। সেই হিসাবে বাসের যাত্রীদের ৯০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হবে।
প্রতিবছর ঈদে ঢাকা মহানগরে চলাচলকারী সিটি সার্ভিস বাসগুলো ঈদের দুই দিন আগে থেকে যেকোনো গন্তব্যে গেলে ঈদ বকশিসের নামে ৫০ টাকা হারে যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করে থাকে। এবারও ঈদের আগের দুই দিনে ঢাকার চার হাজার সিটি বাসে ৪৮ লাখ ট্রিপে যাত্রীদের কাছ থেকে গড়ে মাথাপিছু ৩০ টাকা হারে বাড়তি নিলে এ খাতে ১৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা যাত্রীদের বাড়তি গুনতে হবে।
এবারের ঈদে অতিরিক্ত কোচ, ঈদ স্পেশাল হিসেবে অতিরিক্ত রেল রেক যুক্ত করার পর ঢাকা থেকে সাত লাখ যাত্রী দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছেন। দৈনিক ৪০ হাজার যাত্রী নিয়মিত টিকিটের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ স্ট্যান্ডিং টিকিটসহ ৪৬ হাজার টিকিটধারী যাত্রী ঢাকা ছাড়বেন। সেই হিসাবে এক সপ্তাহে তিন লাখ দুই হাজার যাত্রী রাজধানী ছাড়বেন। এর বাইরে ট্রেনের ছাদে, ইঞ্জিনে, দুই বগির মাঝে, কোচের ভেতরে বিনা টিকিটে যাতায়াত করবেন আরও প্রায় তিন লাখ ৭৮ হাজার যাত্রী। এত বড় সংখ্যক যাত্রী বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণে কর্তৃপক্ষ বড় ধরনের রাজস্ব হারালেও চলমান ট্রেনে কর্মরত টিটিই, গার্ড, সরকারি-বেসরকারি স্টুয়ার্ড, বেসরকারি ক্যান্টিন অপারেটরের লোকজন, ট্রেনে দ্বায়িত্বরত জিআরপি, এনআরবি ও স্টেশনে দ্বায়িত্বরত টিকিট চেকারদের যাত্রীপ্রতি গড়ে ৩০০ টাকা হারে মোট ১১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ঘুস দিতে হবে।
আকাশপথে সরকারি-বেসরকারি উড়োজাহাজে ঈদের ১০দিন আগে থেকেই অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের মহোৎসব চলে। কোনো কোনো পথে দিগুণ-তিনগুণ বাড়তি ভাড়া আদায় চলছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, ঈদের আগে লক্ষাধিক যাত্রী অভ্যন্তরীণ রুটে আকাশপথ ব্যবহার করতে পারেন। যাত্রীপ্রতি গড়ে সাড়ে তিন হাজার টাকা বাড়তি ভাড়া দিলে ৩৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত যাবে।
সদরঘাট নদীবন্দরসহ বিভিন্ন লঞ্চ ও খেয়াঘাটে নৌ-পথে যাতায়াত ও খেয়া পারাপারের যাত্রী সাধারণের কাছ থেকে ঈদ উপলক্ষে দুই টাকার মাসুল ঘাট ইজারাদারের লোকজন ১০-২০ টাকা হারে আদায় করে থাকেন। এ সময়ে পণ্য নিয়ে খেয়া পারাপার বা লঞ্চে আরোহণে ৫০০ থেকে এক হাজার হাজার টাকা পর্যন্ত কুলি মজুরি চার্জ দাবি করা হয়। খেয়া পারাপারে ঈদবাজারের প্যাকেট প্রতি মাসুল দাবি করা হয়।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব বলছে, এবারের ঈদে সদরঘাট, নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের আশেপাশে খেয়া পারাপারে ১৪ কোটি ট্রিপে যাত্রীদের মাথাপিছু ১০ টাকা হারে বাড়তি হিসাবে ১৪০ কোটি টাকা বাড়তি মাসুল ঘাট ইজারাদারের লোকজন বিআইডব্লিউটিএর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে লুটে নেবেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ৭, ২০২৪
এনবি/আরএইচ