ঢাকা: ঢাকা এবং এর আশপাশের নদ-নদীর পানি ও পানের পানিতে উচ্চ মাত্রায় বিষাক্ত পার-অ্যান্ড পলি-ফ্লুরোঅ্যালকাইল সাবস্ট্যান্সেস (পিএফএএস) বা ‘চিরস্থায়ী রাসায়নিক’ পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এ রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশের ক্ষতির পাশাপাশি মানবদেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমানো, লিভার নষ্টসহ ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে।
এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন (ইএসডিও) এবং আন্তর্জাতিক দূষণকারী নির্মূল নেটওয়ার্কের (আইপিইএন) এক যৌথ গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। ২৯ মে ইএসডিওর ঢাকা অফিসে যৌথ এ গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। গবেষণাটি পরিচালনায় ২০১৯ ও ২০২২ সালে ঢাকা এবং এর আশপাশের পানির নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল।
‘পারসিসটেন্ট থ্রেট: পিএফএএস ইন টেক্সটাইলস অ্যান্ড ওয়াটার ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, অনেক নমুনায় পিএফএসের পরিমাণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্র ও নেদারল্যান্ডসের নির্ধারিত মাত্রার অনেক বেশি ছিল। কিছু নমুনায় নিষিদ্ধ পিএফএএসের উপস্থিতিও পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পিএফএস পরিবেশে জমা হয় ও স্থায়ী থাকে বলে একে চিরস্থায়ী রাসায়নিকও বলা হয়, যা মাটির উর্বরতা, ভ্রূণ বিকাশ এবং থাইরয়েড হরমোন ফাংশনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া কিছু পিএফএস মানবদেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, লিভার নষ্টসহ ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে। রাসায়নিকটি পানি, তেল ও দাগ-প্রতিরোধ করতে পারে। তাই এটি পোশাক কারখানায় ব্যবহৃত হয়। বিশ্বে মোট ব্যবহৃত পিএফএএসের প্রায় ৫০ শতাংশই ব্যবহার করা হয় পোশাক শিল্পে। নির্গমনের দিক দিকে এটি দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।
বাংলাদেশে পিএফএস নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো আইন নেই, তাই এ গবেষণার ফল ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও নেদারল্যান্ডসের মানদণ্ডের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনের ফলে বলা হয়, ৩১টি স্থানের পানির নমুনার মধ্যে ২৭টিতে পিএফএএস পাওয়া গেছে, যার ১৮টিতে নিষিদ্ধ পিএফওএ, পিএফওএস অথবা পিএফএইচএক্সএস পাওয়া গেছে। ১৯টি নমুনায় পাওয়া পিএফএএস প্রস্তাবিত ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রক সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৯ সালে কর্ণফুলী নদীর পানিতে সর্বোচ্চ পিএফএএস শনাক্ত করা হয়েছিল, যা প্রস্তাবিত ইউরোপীয় সীমার চেয়ে ৩০০ গুণ বেশি। সেই নমুনায় দুটি নিষিদ্ধ পিএফএএসেরও উপস্থিতি ছিল, যা নেদারল্যান্ডসের সীমার চেয়ে ১ হাজার ৭০০ থেকে ৫৪ হাজার গুণ বেশি।
আরেকটি নমুনা ২০২২ সালে হাতিরঝিল থেকে নেওয়া হয়। এতে পিএফওএ-পিএফওএস উভয় রাসায়নিকেরই উপস্থিতি ছিল, যা নেদারল্যান্ডসের সীমার চেয়ে ১৮৫ গুণ বেশি। উচ্চ পিএফএএস পাওয়া নমুনাগুলো পোশাক শিল্প কারখানার কাছাকাছি এলাকা থেকে নেওয়া বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এটি প্রমাণ করে, পোশাক শিল্পে পাওয়া পিএফএএস পানি দূষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হতে পারে।
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২২ সালে দুটি জলপথের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ঢাকা ও আদমজী) কাছাকাছি আপস্ট্রিম ও ডাউনস্ট্রিমের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল, যেখানে ডাউনস্ট্রিমের নমুনায় পিএফএএসের উচ্চ ঘনত্ব পাওয়া যায়। এ ছাড়া ২০১৯ সালে সংগৃহীত চারটি কলের পানির নমুনার তিনটিতে এ রাসায়নিক পাওয়া যায়, যা যুক্তরাষ্ট্রের নির্ধারিত সীমার বেশি।
গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পোশাকও পরীক্ষা করা হয়েছে। পাঁচটি নমুনা পোশাকের সবকটিতেই পিএফএএস পাওয়া গেছে এবং একটি পুরুষের জ্যাকেটে নিষিদ্ধ রাসায়নিক পিএফওএ পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে ইএসডিওর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দিকা সুলতানা বলেন, আন্তর্জাতিক পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ অন্যতম। কিন্তু এ খাত থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক নির্গমন জনগণকে উচ্চ ঝুঁকিতে ফেলছে। আমাদের নদী-নালা ও কলের পানিতে পিএফএএস দূষণ ঘটছে। এ কারণে রপ্তানি শিল্প কারখানাগুলোকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। তাদের বাজার বিশ্বব্যাপী হতে পারে, কিন্তু দূষণ স্থানীয় পর্যায়ে বেশি হচ্ছে। স্টকহোম কনভেনশনের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের পিএফএএস নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক মান বাস্তবায়ন করা জরুরি।
ইএসডিওর সিনিয়র পলিসি এবং টেকনিক্যাল উপদেষ্টা এবং গবেষণা প্রধান ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, নদী, লেক, কলের পানি ও পোশাকে পিএফএএস আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য এবং পরিবেশের জন্য গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করে। তবুও শিল্প কারখানা এবং নীতি নির্ধারকদের কাছ থেকে সাড়া মিলছে না। পিএফএএসের রাসায়নিকগুলো একে একে নিয়ন্ত্রণ করতে কয়েক দশক সময় লাগবে, যা আমাদের সন্তানদের ঝুঁকিতে ফেলবে। আমাদের জরুরিভাবে সমস্ত পিএফএএস রাসায়নিকের ওপর বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।
আইপিইএন গ্লোবালের গবেষক এবং এ গবেষণার সহ-লেখক জিটকা স্ত্রাকোভা বলেন, ইতোমধ্যে পোশাক কারাখানায় পিএফএএসের নিরাপদ বিকল্প বের হয়েছে। তাই টেক্সটাইল শিল্পের উচিত পিএফএএসের ব্যবহার দ্রুত বন্ধ করা।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৭ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০২৪
এসসি/আরএইচ