সিলেট: কোটা সংস্কার আন্দোলনে ইস্যুতে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল সিলেট। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ফটক থেকে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে নগরজুড়ে।
গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) ও শুক্রবার (১৯ জুলাই) পুলিশ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। সেই সুযোগ কাজে লাগায় সরকার বিরোধীরা। তারাও ছাত্রদের আন্দোলন পুঁজি করে মাঠে নেমে সংঘর্ষ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও নাশকতার চেষ্টা করে।
শুক্রবার (১৯ জুলাই) রাত ১২টা থেকে প্রথম ধাপে কারফিউ জারি করা হয়। ওইদিন সকাল থেকে দিনভর সংঘাতময় ছিল সিলেট। নগরের বন্দরবাজার, সিটি পয়েন্ট, কোর্ট পয়েন্ট, জিন্দাবাজার, আখালিয়া, শাবিপ্রবি ফটকে পৃথক সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এছাড়া নগরের দক্ষিণ সুরমা, কদমতলী এলাকায়ও সংঘর্ষ হয়। এসব এলাকায় কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে আন্দোলনকারীরা।
গত বৃহস্পতিবার কমপ্লিট শাটডাউন চলাকালে দুপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা শাবিপ্রবি ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশি বাধায় বিশ্ববিদ্যালয় ফটকের সামনে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে রাখে তারা। বেলা ১টার দিকে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। পরে পুলিশ বেশ কয়েকটি সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয় ফটক থেকে নগরের মদীনা মার্কেট পর্যন্ত ২ কিলোমিটার এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বিকেলে নগরের আখালিয়া এলাকায় পুলিশ-ছাত্রলীগের মোকাবেলা করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এসময় ত্রিমুখী সংঘর্ষে গুলিতে ৭ পুলিশ, ছয় সাংবাদিক ছাড়াও অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ ও ইটপাটকেলের আঘাতে আহত হন। এরপর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে নগরের সুরমা গেইট এলাকায় পুলিশের ধাওয়া খেয়ে আন্দোলনকারী চার শিক্ষার্থী পানিতে পড়ে যান। এসময় ৩ জন সাঁতার কেটে ওঠতে সক্ষম হলেও রুদ্র সেন (২২) নামে এক শিক্ষার্থী মারা যান। নিহত রুদ্র সেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যামিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থী। তার গ্রামের বাড়ি দিনাজপুর জেলায়। শিক্ষার্থীদের অনেকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রক্তাক্ত অবস্থায় ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। পৃথক ঘটনায় পুলিশ ছয়জনকে আটক করেছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ জানিয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় পুলিশ আন্দোলনকারীদের ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেয়নি। কিন্তু তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। যে কারণে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও শর্টগানের গুলি ছুঁড়ে।
এদিকে, আন্দোলনের রেশ নগরীতে ছড়িয়ে পড়ে শুক্রবার (১৯ জুলাই)। ওইদিন জুমার নামাজের পর কোটা আন্দোলন ইস্যুতে নগরের কোর্ট পয়েন্ট থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে বিএনপির অংগসংগঠনের নেতাকর্মীরা। মিছিলটি জিন্দাবাজার অভিমুখে রওয়ানা হয়। মিছিলকারীরা পুলিশকে উদ্দেশ্য করে ভুয়া ভুয়া বলে স্লোগান দেয় এবং ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। ওই সময় কোর্ট পয়েন্টে অবস্থান করছিল পুলিশ। তখন এসএমপির সহকারী কমিশনার গোলাম মোহাম্মদ দস্তগীরের নেতৃত্বে পুলিশ সদস্যরা পেছন থেকে মিছিলে টিয়ারশেল ও গুলি ছুঁড়ে। এসময় পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে পুলিশের ছররা গুলিতে গুরুতর আহত হন দৈনিক জালালাবাদ ও নয়াদিগন্ত পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার এটিএম তুরাব।
গুরুতর অবস্থায় সহকর্মীরা তাকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু শুক্রবার থাকায় চিকিৎসকের পরিবর্তে নার্সরা চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ অবস্থা দেখতে পেয়ে সহকর্মীরা তাকে নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের কারণে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক আরিফ মোহাম্মদ রেজা।
পরদিন শনিবার (২০ জুলাই) বেলা ২টায় নগরীর মানিকপীর (রহ.) মাজার সংলগ্ন এলাকায় তার প্রথম জানাযা শেষে মরদেহ গ্রামের বাড়ি বিয়ানীবাজার পৌর এলাকার ফতেহপুরে নেওয়া হয়। সেখানে দ্বিতীয় জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্তানে তাকে দাফন করা হয়। নিহতের ভাই জুবের আহমদ এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেন তিনি।
এই ঘটনার পর শুক্রবার রাতেও নগরীর আখালিয়া, মদীনা মার্কেট, পাঠানটুলা, জিন্দাবাজার, কোর্ট পয়েন্ট, বন্দরবাজার এলাকায় দফায় দফায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় আন্দোলনকারীদের।
অপরদিকে, দেশজুড়ে সংঘাত ছড়িয়ে নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় রাত ১২টা থেকে সেনা মোতায়েন ও কারফিউ ঘোষণা করা হয়। প্রথম দফায় শনিবার সকাল ১২ টা পর্যন্ত কারফিউ ছিল। পরে ২ ঘণ্টা বিরতি দিয়ে বেলা ২টা থেকে দ্বিতীয় দফায় এবং রোববার বিকাল ৩টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়।
কারফিউ চলাকালে শনিবার সিলেটের কোথাও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা রাস্তায় নামেননি। নগরের রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল ছিল সীমিত। দোকানপাট, বিপনী বিতান, মার্কেট, অফিস-আদালত বন্ধ রাখা হয়। কেবল জরুরি সেবার আওতায় থাকা হাসপাতাল, ক্লিনিক, ফার্মেসী, অ্যাম্বুলেন্স, বিদেশি যাত্রীবাহী যানবাহন, গণমাধ্যম কর্মীদের ব্যবহৃত যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে।
এর বাইরেও নগরীতে সিএনজি চালিত অটোরিকশা, ব্যাটারি ও প্যাডেল চালিত রিকশা ছাড়াও হালকা যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে। নগরের বিভিন্ন এলাকায় সেনাবাহিনীর টহল টিম চষে বেড়িয়েছে। সেই সঙ্গে পুলিশ, বিজিবি, আনসার সদস্যরা এখনো মোতায়েন রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৪ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০২৪
এনইউ/এমএম