খুলনা: আমরা না খাইয়ে বসে আছি। সুন্দরবনের নদ-নদীতে মাছ মারতি পারছি না।
বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) সকালে সুন্দরবন সংলগ্ন খুলনা জেলার ৩ নম্বর কয়রা এলাকার জেলে হোসেন আলী নিজের কষ্টের কথা বলতে গিয়ে এসব কথা বলেন।
একই সুরে কয়রার মদিনাবাদ লঞ্চঘাটের জেলে খোকন গাজী বলেন, সুন্দরবনের নদীতে মাছ ধরতে না পেরে এখন অন্যের জমিতে কাজ করছি। কী আর করবো পেট তো চালাতে হবে।
দাকোপ উপজেলার ঝুলন্ত পাড়ার সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল জেলে মো. আজু বৈদ্য বলেন, সুন্দরবনে মাছ ধরা বন্ধ তাই কাম-কাজ নেই। মাছ ধরতে যাওয়ার সরকারি কার্ড আছে। আগে চাল পেতাম। কিন্তু দুই বছর কোনো কিছু পাই না।
জেলে জিল্লুর রহমান বলেন, সুন্দরবনের মাছ ধরতি পারি না। মাছ ধরা নিষেধ। পোলাপান নিয়ে কী খামু।
পাইকগাছার শান্তা এলাকার শাফায়াত হোসেন জানান, সুন্দরবন প্রবেশে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা চলছে। এতে কর্মহীন হয়ে পড়েছে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল এ এলাকার অনেক পরিবার। এসব পরিবারের নারী-পুরুষসহ অন্যান্য সদস্যরা সাধারণত সুন্দরবন, সুন্দরবন সংলগ্ন খাল, নদ, নদী ও তৎসংলগ্ন সাগরে মাছ, কাঁকড়া ও বনজ সম্পদ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। কিন্তু এখন কাজ না থাকায় তারা খুব কষ্টে আছেন।
নিজেদের অসহায়ত্বের কথা তুলে বেশ কয়েকজন জেলে বলেন, সুন্দরবনে মাছ, কাঁকড়া আহরণ করেই আমাদের চলে। তিন মাস পাস বন্ধ থাকায় সীমাহীন কষ্টে আছি। পাস পারমিট বন্ধ করে দেওয়ায় এখন খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছি। সরকারি সুযোগ-সুবিধাও পাচ্ছি না।
তিন মাসের জন্য সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করায় কর্মহীন হয়ে পড়েছে সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলের হাজার হাজার জেলে। ফলে কর্মহীন হয়ে পড়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। ঋণের জালে আটকে পড়েছেন অসংখ্য কর্মহীন জেলে।
ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্সের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, সুন্দরবনের ৯৫ শতাংশ জেলে ঋণের জালে আটকা পড়েছে। এ জেলেদের প্রায় ৯০ শতাংশ তাদের মাছ ধরার প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় ঋণ সুরক্ষিত করার জন্য খাদ্য, জ্বালানি, নৌকা, সংগ্রহের জন্য ‘মহাজন’ ‘দাদন’-এর মতো মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে।
সুন্দরবনের মৎস্য সম্পদ রক্ষায় গত ১ জুন থেকে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলেও এখনও পর্যন্ত বনজীবী পরিবারগুলোর কাছে পৌঁছায়নি কোনো সরকারি সহায়তা।
সুন্দরবন পশ্চিম বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের ওপর প্রায় দেড় লাখ মানুষ কোনো না কোনোভাবে নির্ভরশীল। প্রতিবছর ১২ হাজারের বেশি জেলে পাস নিয়ে সুন্দরবনে মাছ ধরতে যায়।
জানা গেছে, সুন্দরবনের ভেতরে ১৩টি বড় নদীসহ ৪৫০টির মতো খাল রয়েছে। এসব নদীতে পাঙাশ, ইলিশ, ভেটকি, রূপচাঁদা, দাঁতিনা, চিত্রা, পোয়া,লইট্যা, ছুরি, মেদ, পাইস্যা, তপসে, লাক্ষা, কই, কাইন মাগুরসহ ২১০ প্রজাতির সাদা মাছের দেখা মেলে। এছাড়া এখানে গলদা, বাগদা, চাকা, চালী, চামীসহ ২৪ প্রজাতির চিংড়ি পাওয়া যায়। শিলা কাঁকড়াসহ ১৪ প্রজাতির কাঁকড়ার প্রজনন হয় এখানে।
খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল বাংলানিউজকে বলেন, সুন্দরবনে যে তিন মাস মাছ ধরা বন্ধ থাকে তখন সুন্দরবনের মৎস্যজীবীদের কোনো প্রণোদনা দেওয়া হয় না। তবে সাগরে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই ৬৫ দিন মাছ ধরা বন্ধ থাকে তখন সাধারণ জেলেদের প্রণোদনা দেওয়া হয়, তার মধ্যে সুন্দরবনের কিছু জেলে রয়েছে। খুলনা জেলায় ২৩ হাজার জেলেকে প্রণোদনা দেওয়া হয়।
খুলনা অঞ্চলের প্রধান বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো বাংলানিউজকে বলেন, নির্দেশনা অনুযায়ী ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ৩ মাস সুন্দরবনে মাছ ধরা নিষেধ রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে কোনো নৌযান সুন্দরবনের অভ্যন্তরের খালগুলোতে চলাচল করতে পারছে না। নিষেধাজ্ঞার এ সময়ের জন্য বনজীবীদের প্রণোদনার তালিকার যাচাই-বাছাই চলছে। বাছাইয়ের কাজ শেষ করে এ বছর প্রণোদনা দেওয়া সম্ভব হবে না। আগামী বছর দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৭ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০২৪
এমআরএম/আরবি