তার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না সরকারি রাস্তাঘাট, স্থাপনাসহ স্থানীয়দের বাড়ি-ঘর। এখন হুমকির মুখে রয়েছে পরিবেশ ও ফসলী জমি।
এক সময়ের সেই নৌডাকাত আজ গড়ে তুলেছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ। নিজের ৫/৬টি বাড়ির পাশাপাশি কয়েকটি ইটভাটাসহ একাধিক জমি কব্জায় এনেছেন তিনি। তার নাম সুজন মিয়া। দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জের কোন্ডা ইউনিয়নের শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
সুজনের সব অপকর্ম হচ্ছে খোদ পুলিশের সামনেই। এলাকাবাসীর অভিযোগ, ওই নৌডাকাতের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ করা হলে, উল্টো পুলিশই গ্রামবাসীদের নামে মামলার হুমকি দেয়। যদিও প্রশাসন বলছে, বিষয়টি নিয়ে তারা তৎপর। অন্যায়কারী যেই হোক, তাকে বিচারের আওতায় আনা হবে।
জানা গেছে, দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জের কোন্ডা ইউনিয়নের ব্রাহ্মণগাঁও, কাজীরগাঁও, দক্ষিণ পানগাঁও, পানগাঁও এবং কাউটাইল এলাকায় সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী গড়ে তুলেছেন সুজন মিয়া, ডন এবং পলাশ। তাদের গঠিত বাহিনী এলাকায় চাঁদাবাজির পাশাপাশি দখলদারের রাজত্ব করছে।
সুজনরা ফসলি জমি, রাস্তাঘাটসহ অন্যান্য জমি জবরদখল করে মোটা অংকের বিনিময়ে মাটি বিক্রি করছেন। এতে জমিতে তৈরি হচ্ছে গভীর খাদ, উৎপাদন করা যাচ্ছে না কোনো ফসল। বৃষ্টি এলে তলিয়ে যায় গোটা এলাকা। এতে একদিকে যেমন ফসলি জমি শেষ হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে পরিবেশও রয়েছে মারাত্মক হুমকিতে। মাটি উত্তোলনের ফলে অনেক বাড়ি-ঘর এরইমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। ভেঙে পড়েছে রাস্তা। উজাড় হয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি।
এছাড়া তার গঠিত বাহিনী এলাকাবাসীর কাছ থেকে শুরু করেছে চাঁদাবাজি। নিদিষ্ট চাঁদা না পেলে দেয়া হয় হত্যার হুমকি। তার চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই এলাকা ছাড়ার হুমকি দেয়া হয়। আর এসব কর্মকাণ্ড খোদ পুলিশের সামনে করলেও পুলিশ অজানা কারণে নীরব থাকে।
কুয়েত প্রবাসী ইসলাম ২০ লাখ টাকা দিয়ে ৬ শতাংশ জমি কিনেছিলেন। তার কেনা জমিতে চলতি বছরের শুরুর দিকে বাড়ি তৈরির ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু তার জমির কোনো চিহ্ন নেই। তার জমিসহ ব্রাহ্মণগাঁওয়ের এলাকাটি এখন গভীর খাদ।
একই অবস্থা গ্রামটির হালিম দোকানদার, দেলোয়ার, আয়ুব আলী, আফসারসহ পাঁচ/ছয়টি গ্রামের ৫০ হাজার বাসিন্দার। এ বিষয়ে হালিম বলেন, ‘দিন ও রাতের বেলায় সুজন, ডন ও পলাশের লোকজন আমার বাড়ির জমিটি শেষ করে দিয়েছে। এখন আর বাড়ি করার উপায় নেই। পুলিশকে জানালে উল্টো পুলিশ মামলার হুমকি দেয়। ’
খুকি বলেন, ‘আমার জমির ওপর ছোট ঘর তৈরি করেছিলাম। ইচ্ছা ছিলো ইটের বাড়ি বানানোর। কিন্তু আমার জমিতে জোর করে মাটি ও বালু উত্তোলন করায় জমির কোনো চিহ্ন নেই। এখন অন্যের বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। ’
স্থানীয় মেম্বার (ইউপি সদস্য) হারুন উর রশিদ রাসেল বলেন, ‘সুজন, ডন ও পলাশের বাহিনী জমি দখল করে অবৈধভবাবে মাটি উত্তোলন করছে ২ বছর ধরে। আমরা গ্রামবাসী একত্রিত হয়ে বেশ কয়েকবার প্রতিবাদ করেও লাভ হয়নি। তাদের সঙ্গে পুলিশের পাশাপাশি একাধিক সন্ত্রাসী থাকে। দিনের বেলায় প্রতিবাদ করলে রাতে তারা এসে হত্যার হুমকি দেয়, গুলি করে। ৫/৬টি গ্রাম রক্ষায় আমরা সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করি। ’
এ বিষয়ে সুজনের সঙ্গে সরাসরি দেখা করে কথা বলতে চাইলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। উল্টো মিডিয়ার কথা শুনে তার বাহিনীর সদস্যরা বাংলানিউজসহ প্রায় আটজন সাংবাদিকের ওপর চড়াও হয়। ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে ক্যামেরা, মোবাইলসহ বিভিন্ন জিনিস।
এ বিষয়ে দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ জামান বাংলানিউজকে বলেন, ‘এলাকাটিতে দু’পরে মধ্যে ঝামেলা হয়েছিলো। সেটি আমরা বন্ধ করেছি। এখন কোন্ডা ইউনিয়ন থেকে কোনো ধরনের মাটি উত্তোলন হচ্ছে না। ’
তবে সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিনে গিয়ে এই প্রতিবেদক ২০টিরও অধিক ট্রাকে মাটি পরিবহন ও উত্তোলনের চিত্র দেখেছেন, যার তথ্য প্রমাণ সংরক্ষিত আছে। এই বিষয়ে ওসি বলেন, ‘আমার এ বিষয়ে কিছু জানা নেই।
এলাকাবাসীকে সহযোগিতার পরিবর্তে হয়রানি করা হয় এমন অভিযোগ এলাকাবাসীর। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শ্রমিক নেতা সুজনকে আমি মদদ দেই না। তাদের বিরুদ্ধে আমি মামলা গ্রহণ করেছি। সে মামলার অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য না করে ফোন রেখে দেন।
তবে উপজেলা প্রশাসন বলছে, অন্যায়কারী যেই হোক, তাকে বিচারের আওতায় আনা হবে। এ বিষয়ে কেরাণীগঞ্জে উপজেলা নির্বাহী অফিসার অমিত দেব নাথ বলেন, ‘আমরা ফসলি জমি বা বিভিন্ন জমিতে মাটি উত্তোলনের বিষয়টি নিয়ে তৎপর আছি। আমরা যেহেতু বিষয়টি জানতে পেরেছি, অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। ’
তিনি বলেন, ‘ভেপু (মাটি উত্তোলনের যন্ত্র) ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার নিষিদ্ধ, তবে সরকারি কোনো স্থাপনা বা রাস্তাঘাট নির্মাণে ব্যবহার করা যায়। এখন জানতে পারলাম সেখানে একটি গোষ্ঠী এটা ব্যবহার করে মাটি উত্তোলন করছে। আমি অবশ্যই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবো। ’
কে এই সুজন মিয়া: আজ থেকে ১০/১২ বছর আগে সুজন মিয়া বুড়িগঙ্গা নদীতে মাঝির কাজ করে সংসার চালাতেন। পরে মাঝি থেকে হয়ে যান নৌডাকাত, গড়ে তোলেন করেন সন্ত্রাসী সংগঠন। নিজ কব্জায় নিয়ে নেন ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
সংগঠনের নাম ভাঙ্গিয়ে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার সম্পদ দখলে নেন। শুরু করেন ফসলি জমির মাটি ও বালু উত্তোলন। এগুলো বিক্রি করতে থাকেন বিভিন্ন ইটভাটাসহ বিভিন্ন জায়গায়। জোরদখল করে অন্যের জমির মাটি উত্তোলন করে গভীর খনন করেন। এতে বসত-বাড়ি ও সরকারি রাস্তায় হুমিকির মুখে পড়ে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২০ ঘন্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২০
ইএআর/এজে/এইচজে