পিরোজপুর: পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার দক্ষিণ কামারকাঠি গ্রামের মেয়ে সাবনূর। মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি।
সাবনূরের বাবা দিনমজুর বাবুল মোল্লা ৯ বছর ধরে হাঁপানি রোগী। মেয়ের মেডিক্যাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার খবরে বাবা ও মা সাবিনা বেগম খুশিতে আত্মহারা হলেও দুশ্চিন্তায় পড়েছেন অভাব অনটনের সংসারে কিভাবে পড়াশোনার খরচ চালাবেন এই ভেবে।
সাবনূর সদ্য প্রকাশিত মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় জামালপুর শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজে চান্স পেয়েছেন। চলতি বছরে ওই উপজেলা থেকে সাবনূরের একার এ অসামান্য কৃতিত্বে তার শিক্ষকরাও খুব খুশি।
এলাকাবাসী বলছেন, সাবনূরের পরিবারের পক্ষে মেডিক্যালে ভর্তি এবং তার পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যাওয়া কষ্টসাধ্য ব্যাপার তাই দুশ্চিন্তায় পড়েছে তার পরিবার। তারা বলেন, বরিশালের বানারিপাড়ার রিকশাচালক বাবার মেয়ে হারিসার মেডিক্যালে পড়ার খরচের দায়িত্ব নিয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ। কিন্তু সাবনূরের দায়িত্ব নেবে কে? বাবুল মোল্লার মেয়ের পড়ার খরচ চালাতে এমন কেউ যদি এগিয়ে না আসে তাহলে সাবনূরের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।
সাবনূরের বাবা বলেন, আমার ১ ছেলে, ২ মেয়ে। আমি দিনমজুরী করে সংসার চালাই। তার ওপর দীর্ঘদিন ধরে অ্যাজমা রোগে আক্রান্ত। আগের মত কাজও করতে পারি না। আমার একার আয়ে পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণই কষ্ট হয়। তার ওপর তিন ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাতে গিয়ে ধার দেনায় জর্জারিত। সংসার চালাতে আমার স্ত্রীও অন্যের বাড়িতে কাজ করে।
তিনি বলেন, সাবনূর ছোট থেকে ছাত্রী হিসেবে ভালো ছিল। তার শিক্ষকরা তাকে নিয়ে গর্ব করত। পঞ্চম শ্রেণিতে কৃতিত্বের সঙ্গে রেজাল্ট করে, এসএসসি পরীক্ষায় কামারকাঠি বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে গোল্ডেন এ প্লাস অর্জন করে। সে সময়ে ওকে ভালো প্রাইভেটও দিতে পারিনি। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কথায় তাদের সহযোগিতায় উপজেলার শহীদ স্মৃতি ডিগ্রি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করাই। কলেজের শিক্ষকদের আমাদের অবস্থার কথা খুলে বললে তারা মেয়েকে সহযোগিতা করেন। মোট কথা প্রাথমিক থেকে শুরু করে কলেজ পর্যন্ত শিক্ষক ও সহপাঠীরা বিভিন্নভাবে সাবনূরকে সহযোগিতা করেছে।
সাবনূরের মা কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, এমন দিনও গেছে অভাবের কারণে আমার মেয়েটা না খেয়েও কলেজ করেছে। এমনকি এখনও সে অভাব তাদের সংসারে লেগেই আছে।
তিনি আরও বলেন, আমি সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন আমার বাবা আমাকে বিয়ে দেন। তখন আমার পড়াশোনার খুব ইচ্ছা ছিল। তা পারিনি। সেই থেকে মনে মনে পণ করি আমার ছেলে-মেয়ে হলে তাদের ইচ্ছানুযায়ী পড়াশোনার সুযোগ দেব। সংসারের অভাবের কারণে আমি মানুষের বাড়িতে মাঝে মাঝে কাজ করি। রাত ভরে ঘরে বসে পাটি ও হাত পাখা বুনন করি। অভাবের কারণে মেয়েকে কলেজে আসা যাওয়ার ভাড়াও দিতে পারিনি। মেয়ে আমার বাসা থেকে আট কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে কলেজ করত। দুপুর হলে আবার হেঁটে বাড়িতে আসত। শহীদ স্মৃতি ডিগ্রি কলেজ থেকে ২১-২২ শিক্ষাবর্ষে মেয়ে আমার গোল্ডেন এ প্লাস পায়। ওর প্রাইমারি থেকে এ পর্যন্ত রেজাল্ট দেখে কলেজের মাহমুদ স্যার মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার কথা বলেন। এতে তিনি আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছেন। এখন মেয়ের ভর্তি ও পড়ার খরচ কিভাবে চালাব তা ভেবেই পাচ্ছি না।
সরেজমিনে সাবনূরের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, মেয়ের মেডিক্যালে চান্স পাওয়ায় বাড়িতে নেই কোনো আয়োজন। সাবনূরের মা-বাবার চোখে আনন্দ দেখা গেলেও ভেতরে ডুবে আছেন গভীর দুশ্চিন্তায়। এখন মেডিক্যালের ভর্তির খরচ যোগাতে দিশেহারা বাবা বাবুল মোল্লা ও মা সাবিনা বেগম।
শিক্ষার্থী সাবনূর বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা জীবন থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত আসতে শিক্ষক সহপাঠীদের অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা পেয়েছি। আমি মেডিক্যালে চান্স পেয়ে এখন ভর্তির জন্য অনেকটা দুশ্চিন্তায় আছি। মা-বাবা এ নিয়ে মন খারাপ করে আছেন। যদি মেডিক্যালে ভর্তি হতে পারি ডাক্তার হয়ে আমি আমার দিনমজুর বাবা ও মায়ের মুখ উজ্জ্বল করব। এ জন্য আমি আমার শুভাকাঙ্ক্ষিদের কাছে দোয়া চাচ্ছি।
নেছারাবাদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোসারেফ হোসেন বলেন, আমি তাদের আমার অফিসে আসতে বলছি। ঘটনা শুনে সাবনূরের মেডিক্যাল ভর্তিতে যা খরচ হয় তা আমরা বহন করব।
বাংলাদেশ সময়: ১৯১০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০২২
আরএ