ঢাকা: জেলে ও সামুদ্রিক খাদ্য সেক্টরের শ্রমিকদের অবস্থা বিষয়ক আঞ্চলিক গবেষণা প্রতিবেদনে মৎস্যখাতে ‘দাসত্বের’ দাদন (শর্তযুক্ত ঋণ) প্রথা বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া সামুদ্রিক খাদ্য সেক্টরের বৈশ্বিক ভ্যালু-চেইনে ন্যায্য মূল্য ও ন্যায্য-মজুরী নিশ্চিত, অন্যায্য ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধে যথাযথ আইন প্রণয়ন ও আইনের ব্যবহার নিশ্চিত, ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী বা জেলে ও শ্রমিকদের ওপর অনাচার-শোষণ বন্ধ এবং চিংড়ি চাষিদের জন্য লাভজনক ন্যূনতম মূল্য ঘোষণা ও মূল্য-সহায়তার সুপারিশও করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
বুধবার (২৮ সেপ্টেম্বর) ঢাকা রির্পোটার্স ইউনিটি মিলনায়তনে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই সুপারিশ করা হয়।
অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সাউথ এশিয়ান অ্যালান্স ফর প্রভার্টি ইরাডিকেশন (স্যাপি), বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ (বিএনপিএস), টেক্সটাইল গার্মেন্টস ওয়ার্কারস ফেডারেশন, ইনসিডিন বাংলাদেশ ও জনউদ্যোগ।
অনুষ্ঠানে গবেষণা তথ্য তুলে ধরে স্যাপির অ্যাডভোকেসি ও মনিটরিং অফিসার রেশমা সায়কা বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মুনাফাতাড়িত রফতানি নির্ভর সামুদ্রিক-খাদ্যের ভ্যালু চেইনে মানবাধিকার লঙ্ঘন, ঋণগ্রস্ততা ও বৈষম্য রয়েছে। বিশেষভাবে জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য অনেক বেশি। সামুদ্রিক খাদ্যের ভ্যালু-চেইনে রপ্তানিকারক ও প্রক্রিয়াজাতকরণে নিয়োজিতরা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী। সেখানে বৈশ্বিক ভ্যালু-চেইনে ক্রিয়াশীল অ্যাক্টরদের ক্ষমতার অসম-বিন্যাসের কারণে মানুষের দুর্দশা পাকাপোক্ত হচ্ছে।
গবেষক মো. শহীদুল্লাহ বলেন, অধিকাংশ মৎস্যজীবী-জেলে দরিদ্র, নিজেদের নৌকা বা জাল নেই। তারা কাজ করেন দৈনিক মজুর হিসেবে। তারা সবসময় নৌকার মালিক বা মহাজনের কাছ থেকে আগাম-ঋণ বা দাদন নিয়ে থাকেন। নৌকার মালিকের সঙ্গে জেলেদের কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তিপত্র থাকে না। তারা আগাম ঋণ বা দাদনের বিনিময়ে শ্রম বিক্রি করেন। দাদনের কারণে জেলেরা মহাজন বা নৌকার মাালিকের কাছে জিম্মি থাকেন।
ড. সৈয়দ আলী আজহার বলেন, মৎস্য অধিদফতরের নিবন্ধিত জেলেদের ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত সরকারের নীতি অনুযায়ী মাছ ধরার সময় কোনো জেলে নিখোঁজ হলে বা মারা গেলে তার পরিবার সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। এছাড়া স্থায়ীভাবে পঙ্গু ব্যক্তিদের জন্য সর্বোচ্চ এককালীন আর্থিক সহায়তা হিসেবে ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান রয়েছে। যা যথেষ্ট নয়, আবার সেই বিধান পুরোপুরি কার্যকর নয়।
ট্রেড ইউনিয়ন নেতা রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, ধ্বংসাত্মক উপায়ে অতি-আহরণ বাংলাদেশের সামুদ্রিক-মৎস্যখাতের একটা বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমানে দু’শোটিরও অধিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলার এবং ৬৮ হাজারের মতো দেশীয়-ইঞ্জিনচালিত নৌকা রয়েছে; যা উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় ধ্বংসাত্মক প্রযুক্তি ও কৌশল অবলম্বন করে বেআইনিভাবে মৎস্য আহরণ করছে। তাই মৎস্যখাতের উন্নয়নে সুনির্দ্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে।
উন্নয়নকর্মী কে এম মুস্তাক আলী বলেন, ২০০১ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলারের সংখ্য তিনগুণের বেশি বেড়েছে। ওই সব ট্রলার বেআইনিভাবে সাগরের তলদেশে মৎস্য আহরণ করছে। যা শুধু সামুদ্রিক-বাস্তুসংস্থানেরই ক্ষতি করছে না, প্রচলিত পদ্ধতিতে মৎস্য আহরণকারী জেলেসম্প্রদায়ের জীবিকাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। ঝুঁকি মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
সভাপতির বক্তব্যে শ্রমিকনেতা আবুল হোসেন বলেন, সামুদ্রিক মৎস্য শিকারি ট্রলার ইন্ডাস্ট্রি আনুষ্ঠানিক খাত হলেও তাদের কর্মপরিবেশ অনিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে নিয়োজিত অধিকাংশ শ্রমিক অস্থায়ী, যাদের চাকুরির নিরাপত্তা নেই। মৌসুম শেষে চাকুরি থাকে না। ওই সব শ্রমিকদের নেই নিয়োগপত্র, সার্ভিসবুক এবং পরিচয়পত্র বা আইডেনটিটি কার্ড। তাদের শুধু মৎস্য অধিদফতর থেকে ইস্যু করা অনুমোদন কার্ড রয়েছে। এ খাতের শ্রমিকরা সরকার ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি থেকেও বঞ্চিত বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বিএনপিএস-এর উপ-পরিচালক ও স্যাপির কোর কমিটির সদস্য শাহনাজ সুমীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনের উপর আলোচনা করেন মৎস্য অধিদফতরের সাসটেইনেবেল কোষ্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্টের কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড মোবিলাইজেশন এক্সপার্ট ড. সৈয়দ আলী আজহার, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা রাজেকুজ্জামান রতন, ইনসিডিন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক কে এম মুসতাক আলী, অ্যাডভোকেট মলয় ভৌমিক, মাছ ব্যবসায়ি এম জাহাঙ্গীর, নূরুল ইসলাম ও সাবিহা ইয়াসমিন প্রমুখ।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২২
এসএমএকে/এসএ