ঢাকা, মঙ্গলবার, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

রামু ট্রাজেডির ১০ বছর

১০ বছরেও খোঁজ নেই সেই উত্তম বড়ুয়ার, পরিবারে দুর্দিন

সুনীল বড়ুয়া, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২২
১০ বছরেও খোঁজ নেই সেই উত্তম বড়ুয়ার, পরিবারে দুর্দিন উত্তম বড়ুয়ার মা-বাবা

কক্সবাজার: ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ বিহার ও বসতিতে ন্যক্কারজনক হামলার ১০ বছর পূর্ণ হলো আজ। কিন্তু সেই ঘটনার বিচার হয়নি।

সাক্ষীর অভাবে ঝুলে আছে ১৮টি মামলা।

আর যার ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ নিয়ে ওই ট্র্যাজেডি সংঘটিত হয়, উত্তম বড়ুয়া নামের সেই বৌদ্ধ যুবকের সন্ধান মেলেনি আজও। তবে তার মা মাধু বড়ুয়ার ধারনা, উত্তম বেঁচে আছে।

পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে অর্থকষ্টে চরম দুরাবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন বলে জানালেন উত্তমের বাবা সুদত্ত বড়ুয়া। অন্যদিকে ১০ বছরে একটি মামলারও বিচার শেষ না হওয়ায় হতাশ বৌদ্ধ সম্প্রদায়।

২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা থেকে কক্সবাজারের রামুতে প্রতিবাদ মিছিল, মিটিং শুরু হয়। অভিযোগ, উত্তম বড়ুয়া নামের এক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুক প্রফাইলে পবিত্র কোরআন অবমাননা করা হয়েছে। সময় গড়ানোর সাথে সাথে উত্তজনা বাড়তে থাকে রামুর বৌদ্ধপল্লীগুলোতে। পরে ঘটনা আর শুধু উত্তেজনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না।

 

মিছিল মিটিং, ভাংচুর লুটপাট চালিয়ে ওইদিন পৌনে ১২টার দিকে প্রথম অগ্নিসংযোগ করা হয় ফতেখাঁরকুলের শ্রীকুল গ্রামে অবস্থিত কয়েকশ’ বছরের পুরনো বৌদ্ধ পুরাকীর্তি লালচিং-এ। এরপর সাদাচিং, মৈত্রী বিহার, অপর্ণাচরণ বৌদ্ধ বিহার, রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহার, জাদীপাড়া আর্য্যবংশ বৌদ্ধ বিহার, উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বন বিহার, বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রসহ ১২টি বৌদ্ধ বিহারে। পুড়িয়ে দেওয়া হয় রামু সীমা বিহার সংলগ্ন ২৬টি বসত ঘর। একই অভিযোগে পরের দিন ৩০ সেপ্টেম্বর উখিয়া, টেকনাফ ও পটিয়ার বিভিন্ন বৌদ্ধমন্দিরে একই ধরনের হামলা হয়।

১০ বছরেও সন্ধান মেলেনি সেই উত্তম বড়ুয়ার
যার ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে বৌদ্ধ বিহার ও বসতিতে হামলা চালানো হয়, ঘটনার পর থেকে সেই উত্তম বড়ুয়া নিখোঁজ। এদিকে একমাত্র ছেলের সন্ধান না পেয়ে আর্থিক অভাব অনটনের মাঝে চরম দুর্দিন যাচ্ছে উত্তমের পরিবারে। একমাত্র ছেলে ফিরে আসবে এমন আশায় বুক বেঁধে আছেন রামুর ফতেখাঁরকুলের হাইটুপী গ্রামের বাসিন্দা উত্তমের বাবা সুদত্ত বড়ুয়া ও মা মাধু বড়ুয়া।

উত্তমের মা মাধু বড়ুয়া  জানান, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ঘটনার দিন রাত সাড়ে নয়টার দিকে মোবাইলে উত্তমের সঙ্গে কথা হয়েছিল।  

‘আমাদের যখন পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে তখন তাকে ফোন দিয়েছিলাম। সে আমাকে বলেছে, মা এই কাজ আমি করিনি, এটা ষড়যন্ত্র। এর পর পুলিশ আমার কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নেয়। এটাই ছিল উত্তমের সঙ্গে শেষ কথা।

এরপর থেকে আর ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ছেলে বেঁচে আছে কিনা জানি না। তবে আমার মন বলছে উত্তম বেঁচে আছে, বলেন মাধু বড়ুয়া।

তিনি বলেন, উত্তম ছিল সংসারের উপার্জনের একমাত্র ব্যক্তি। ১০ বছর হয়ে গেছে ছেলের কোনো হদিস নেই। অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটছে এখন। এখন কেউ আর খবরও রাখে না।

উত্তমের বাবা সুদত্ত বড়ুয়ার বয়স এখন প্রায় ৬০ বছর। তিনি বলেন, বয়স হওয়াতে এখন কাজকর্ম করতে পারি না। হাঁপানিসহ নানা রোগে আক্রান্ত। ছোট মেয়েটা প্রতিবন্ধী। এ অবস্থায় পরিবারের ভরণ পোষণ নিয়ে খুব কষ্টে আছি। এমন পরিস্থিতিতে ছেলের সন্ধানে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা চান উত্তমের বাবা সুদত্ত বড়ুয়া।

 

সাক্ষীর অভাবে ঝুলে আছে ১৮টি মামলা
সেদিনের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে এজাহারভুক্ত ৩৭৫ জন এবং অজ্ঞাত আরও ১৫/১৬ হাজারজনকে আসামি করে ১৮টি মামলা করে। পরে এসব মামলায় প্রায় ১ হাজারেরও বেশি মানুষকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগ পত্র জমা দেয় পুলিশ।  

কিন্তু ১০ বছর পার হলেও এখনও পর্যন্ত একটি মামলার বিচার কাজ শেষ হয়নি। এমনকি যারা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল সবাই এখন জামিনে আছেন। এ অবস্থায় বিচার কাজ নিয়ে হতাশ বৌদ্ধ সম্প্রদায়।  

রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিপুল বড়ুয়া আব্বু বলেন, এ ঘটনায় যে ১৮ মামলার বিচার কাজ এখনও ঝুলে আছে, সবকটি মামলার বাদী হচ্ছে পুলিশ। ১০ বছর পার হলেও কোনো মামলার বিচার শেষ হয়নি।

‘এসব মামলার প্রকৃত অপরাধীদের অনেককেই অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আমরা খবর নিয়ে জেনেছি, ১০ বছরে এসে মামলাগুলোর সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না। প্রকৃত অপরাধীদের অনেককে চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়ায় সাক্ষ্য দিতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন’, বলেন বিপুল।

 

কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি ও রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহা বিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, আলোচিত এ হামলার ঘটনায় এলাকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে যে সংকট তৈরি হয়েছিল, গত ১০ বছরে তা অনেকটা ঘুচে গেছে।  

তিনি বলেন, ঘটনার পর পর সরকার ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধ বিহার ও বাড়ি ঘরগুলো পুণঃনির্মান করে দিয়েছে। বিশেষ করে পুনর্বাসনের দিকটায় সরকারের কোনো অবহেলা ছিল না। তবে বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে চরম অসন্তোষ রয়েছে।

এ ধরনের ঘটনার যেন আর পুনরাবৃত্তি না হয় এবং এক রাতে পুড়ে যাওয়া হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনরুদ্ধারে সবাইকে কাজ করার আহবান জানান এই বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু।

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম জানান, বৌদ্ধ বিহারে হামলার ঘটনায় মোট মামলা হয়েছিল ১৯টি। ১৮টি মামলার বাদী ছিল পুলিশ, আর একটি মামলা করেছিলেন সুদাংশু বড়ুয়া নামের এক ব্যক্তি। এ মামলাটি আপস মীমাংসামূলে নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি ১৮টি মামলা এখন বিচার ফাইলে আছে। মূলত সাক্ষীর অভাবে মামলাগুলো ঝুলে আছে।

তিনি বলেন, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কেউ এখন সাক্ষ্য দিতে চাইছেন না। কেউ কেউ সাক্ষ্য দিলেও ঘটনা সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। যে কারণে অনেক সাক্ষী বৈরীও হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪০৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২২
নিউজ ডেস্ক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।