ঢাকা: বাংলাদেশে গত এক দশকে দুধের উৎপাদন পাঁচ গুণ বাড়লেও গড়ে ওঠেনি একটি টেকসই সংরক্ষণ পদ্ধতি বা বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া। ফলে বাধ্য হয়ে কম দামে দুধ বিক্রি করছেন খামারিরা, নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার লিটার দুধ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুধ সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় ছোট খামারিরা বাধ্য হয়ে মিষ্টির দোকান নির্ভর হয়ে পড়েছেন। তাদের বেঁধে দেওয়া দামেই বিক্রি করতে হয় দুধ। ফলে লোকসান দিতে দিতে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেক প্রান্তিক খামারি।
এদিকে দুধের টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করতে গবাদি পশুর জাত উন্নয়ন, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের বাজার ব্যবস্থা জোরদারকরণ, দুগ্ধজাত পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ ও সহজলভ্যতা নিশ্চিতকরণসহ স্কুলফিডিং-এর মাধ্যমে দুধপানের অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিলেও এর সুফল এখনও প্রান্তিক খামারিদের দোরগোড়ায় পৌঁছায়নি।
খামারিরা জানান, সরকারের উদ্যোগ আছে, কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ে সঠিকভাবে পৌঁছায় না। এজন্য অফিসারদের নিয়মিত মনিটরিং করা উচিত, সবকিছুর সাথে সমন্বয় করে দুধের ফ্যাট অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করে সরাসরি খামারিদের কাছ থেকে সরকারের দুধ কেনা উচিত। তাহলে দেশ দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে এবং খামারিরাও লাভের মুখ দেখবে। একইসঙ্গে খামারিদের ঘোষণা দিয়ে প্রণোদনা দিতে হবে। সুদবিহীন লোন দিতে হবে। এক্ষেত্রে সার্ভিস চার্জ ১.৫ শতাংশ ধরতে পারে। পাশাপাশি দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে দুই বছর গুঁড়া দুধের আমদানি বন্ধ করে দেশেই গুঁড়া দুধ তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে নতুন করে খামার তৈরি হবে বেকার সমস্যা দূর হবে। খামারিরাও লাভবান হবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে ক্রমবর্ধমান জিডিপিতে প্রাণিসম্পদের অবদান ৩ দশমিক ২১ শতাংশ। দুধ থেকে বিভিন্ন উপায়ে আধুনিক প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে নানা ধরনের দুগ্ধজাত দ্রব্য উৎপাদন করা হচ্ছে যার সাথে জড়িত আছে বিশাল শ্রমশক্তি। দেশের মোট কর্মসংস্থানের প্রত্যক্ষভাবে ২১ শতাংশ এবং পরোক্ষভাবে ৫০ শতাংশ প্রাণিসম্পদের ওপর নির্ভরশীল। মোট আমিষের ৮ শতাংশ আসে দুগ্ধ সেক্টর থেকে। গত দশ বছরে দেশে দুধ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ। ডেইরি ইন্ডাস্ট্রি এখন দেশের প্রতিষ্ঠিত শিল্প। এই ইন্ডাস্ট্রি দেশের মানুষের পুষ্টি, খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র্য বিমোচনে যে অবদান রাখছে, তা অনস্বীকার্য।
জানা গেছে, বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের বাস্তবায়নাধীন প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়নে ৪ হাজার ২৮০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। প্রকল্পটিতে বিশ্বব্যাংকের বিনিয়োগ ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা প্রাণিসম্পদ সেক্টরে সর্ববৃহৎ বিনিয়োগ। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৩০০টি ভিলেজ মিল্ক কালেকশন সেন্টার স্থাপন করা হবে। এর মধ্যে ১৭৫টিতে কুলিং সিস্টেম দেয়া হবে। এছাড়া আঞ্চলিক পর্যায়ে ২০টি ‘ডেইরি হাব’ স্থাপন, পশু জবাই ও মাংস প্রক্রিয়াকরণের জন্য মেট্রো পর্যায়ে তিনটি আধুনিক মানের স্লটার হাউজ নির্মাণ, জেলা পর্যায়ে ২০টি স্লটার হাউজ নির্মাণ ও উপজেলা-গ্রোউথ সেন্টার পর্যায়ে ১৯২টি স্লটার স্লাব-মাংসের বাজার উন্নয়ন, খামারের বর্জ্য তথা গোবর দিয়ে বিকল্প জ্বালানি ও বায়ো ফার্টিলাইজার উৎপাদন এবং বিপণনের লক্ষ্যে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন, ভেটেরিনারি সেবা আরও বেগবান করা ও মান উন্নয়নের জন্য উপজেলা পর্যায়ে মিনি ডায়াগনস্টিক ল্যাব স্থাপন, মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিক পরিচালনা, ভোক্তা সৃষ্টি ও পুষ্টি সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য পাইলট আকারে স্কুল মিল্ক কর্মসূচি পরিচালনা এবং প্রাণিসম্পদ বিমার মতো কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে।
এ বিষয়ে মানিকগঞ্জ ফেন্ডস ডেইরি ফার্মের মালিক ও মানিকগঞ্জ ডেইরি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. মহিনুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমানে তার খামারে ৩৯টি গরু রয়েছে। রাখাল রয়েছে ৬ জন। এরমধ্যে ২৬টি গরু দুধ দেয়। গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ লিটার দুধ উৎপাদন হয় প্রতিদিন। এরমধ্যে বাসা থেকে ৫৫ টাকা দরে ৪০ শতাংশ ও ৫০ টাকা লিটার দরে বাকি দুধ মিষ্টির দোকানে বিক্রি করি। স্থানীয় বাজারে আরও কম গড় দামে ৫০ টাকা লিটার বিক্রি হয়। যারা এক দুইটা গরু পালে তাদের জন্য দাম ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের মতো খামারিদের খরচ অনেক বেশি পড়ে। ফলে আমাদের কোনো লাভ হয় না। কারণ গোখাদ্যের দাম অনেক বেড়েছে, বিদ্যুৎ বিল, মেডিক্যাল খরচ, সাথে শ্রমিকের মজুরিও বেড়েছে। সব মিলিয়ে ৮০ টাকা লিটারের নিচে দুধ বিক্রি করলে লোকসান গুণতে হয়। আমার ৫৫টি গরু থেকে কমে ৩৯টিতে নেমে এসেছে।
মহিনুর বলেন, জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস বছরে একটা করে খুড়া রোগের ভ্যাকসিন দেয়। মাঝে মাঝে খামারিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। সেখানে তারা দুধ কুলিং মেশিন, মিল্কিং মেশিন, সেইলিং সেন্টারের কথা বলে। কিন্তু বাস্তাবতা অনেক ভিন্ন। এসব কথা প্রশিক্ষণ পর্যন্তই। তারা অতিথি পাখির মতো কাজ করে। কোনো প্রজেক্ট এলে দেখা যায়। অন্য সময় পাত্তা পাওয়া যায় না।
তিনি জানান, সরকারের তরফ থেকে প্রণোদনা আসে। কিন্তু যে খামারিকে ৫ লাখ টাকা দেওয়া দরকার সেখানে দেওয়া হচ্ছে ২০ হাজার টাকা। এজন্য আমরা প্রণোদনা চাই না।
সরকারের উদ্যোগ প্রান্তিক পর্যায়ে সঠিকভাবে পৌঁছায় না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে আমাকে একটি টাকাও দেয়নি। আমাকে একটি মিল্কিং মেশিন, ক্রিম উঠানোর মেশিন ও ফেটারিং মেশিন দেওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু এখন পর্যন্ত দেয়নি। দুধের সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য অনেকবার বলা হয়েছে। তারা শুধু ফ্রিজিং গাড়ি দিতে চায়। যেটা দিয়ে আমি অন্যত্র দুধ বিক্রি করে আসতে পারবো। আমারতো সেটা দরকার নেই। আমাদের লোকাল বাজারে আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন একটি বিক্রি সেন্টার করে সেখানে নির্দিষ্ট দামে দুধ কেনার ব্যবস্থা করলে কোন খামারি আর লোকসান দেবে না।
মহিনুর রহমান বলেন, উন্নয়নের জন্য বিদেশ থেকে ৪ হাজার ২৮০ কোটি টাকার প্রণোদনা এসেছে। সেখান থেকে ক্ষুদ্র খামারিরা আজ পর্যন্ত কোনো সুবিধা পায়নি।
এ খাতের তিনটি প্রধান সমস্যা তুলে ধরেন তিনি। সেগুলো হলো- প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অফিসাররা দায়সারা কাজ করে, দুধের সঠিক দাম নির্ধারণ করা হয় না, বাজারজাতকরণে অব্যবস্থাপনা।
তিনি খামারগুলোতে নিয়মিত মনিটরিং করা, দুধের ফ্যাট অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করা এবং খামারিদের কাছ থেকে সরাসরি সরকারের দুধ কোনার কথা বলেন। খামারিদের প্রণোদনা ও সুদবিহীন ঋণ দেওয়ার বিষয়েও গুরুত্ব দেন।
ফরিদপুরের পশ্চিম খাবাশপুরের খামারি কাজী কামরুল হাসান বাংলানিউজকে বলেন, তার খামারে ৭০টি গরু রয়েছে। ১৮টি গরু থেকে প্রতিদিন ২৬০ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। নিজ উদ্যোগে স্থানীয় বাজারে একটি মিল্ক সেলস সেন্টার তৈরি করে ৭০ টাকা লিটার বিক্রি করেন। কিছু দুধ ৬০ টাকা দরে মিষ্টির দোকানে দেন। তবে গোখাদ্যের দাম বাড়ার কারণে দুধ বেচে লাভ করতে পারেন না।
তিনি বলেন, আমি যে বিক্রয় কেন্দ্র তৈরি করেছি, সেখানে একটি ফিডার মেশিন বসাতে হয়েছে। আমাকে মোটা অংকের টাকা বিনিয়োগ করতে হয়েছে। তারপর গরু থেকে দুধ সংরক্ষণে ৫ জন লোক কাজ করে। যদি মেশিন হতো তাহলে আমার একজনই যথেষ্ট ছিলো। গরু পালনের জন্য আধুনিক শেডের প্রয়োজন। কিন্তু টাকার অভাবে তা করতে পারছি না। এ বিষয়ে যদি সরকার বিনাসুদে ঋণের ব্যবস্থা করতো তাহলে ভালো হতো।
মেশিনপত্র না দিয়ে সরকার যদি প্রণোদনা হিসেবে শুধু গোখাদ্য সরবরাহ বা ভর্তুকির ব্যবস্থা করতো তাহলে খামারিরা টিকে থাকতে পারতেন। ছোট ছোট খামারিরা গরু বিক্রি করে পেশা পরিবর্তন করে ফেলছেন। নতুন করে কেউ এ পেশায় আসতে চাচ্ছে না।
এই খামারি বলেন, বছরের দুই তিন মাস বিশেষ করে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে দুধের চাহিদা কম থাকে। তখন কিছু খামারি ঘি, পনির, মাওয়া, ছানা তৈরি করে। কিন্তু এ পণ্যগুলো বিক্রি করতে হয় ঢাকায়। সেখানেও ন্যায্য দাম পাওয়া যায় না। এজন্য সরকার যদি এগুলো সরাসরি কিনে বাজারজাত করে তাহলে খামারিরা লোকসানের হাত থেকে রক্ষা পায়।
কোম্পানিগুলো দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে দুধ কেনে। তাদের মতো সরকার যদি দেশের প্রতি উপজেলায় নির্ধারিত দামে দুধ কেনার ব্যবস্থা করতো, পাশাপাশি সমিতি গঠন করে ফ্রিজিং ভ্যান দিত, তাহলে দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে আমাদের বেশিদিন লাগতো না। নতুন নতুন খামার তৈরি হতো।
ফরিদপুর জেলার ডেইরি ফার্মস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. মীর কাশেম আলী বাংলানিউজকে বলেন, ফরিদপুরে ২ লাখ ১০ হাজার মেট্রিকটন দুধ উৎপাদন হয়। আর এই জেলায় চাহিদা রয়েছে এক লাখ ৭৪ হাজার মেট্রিকটন। বাকি ৩৬ হাজার টন দুধের মধ্যে কিছু বাই প্রডাক্ট হয়, কিছু নষ্ট হয়। সঠিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় নষ্ট হচ্ছে। এই মুহূর্তে ফরিদপুরের খামারিদের সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। শুধু মিল্ক ভিটার দুইটা স্থানে চিলিং সেন্টার আছে। সেখানে শুধু তাদের নির্ধারিত দুধ নিয়ে থাকে। আমাদের দুধ সেখানে রাখার কোনো সুযোগ নেই। প্রক্রিয়াজাত করণেরও কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে আমরা খামারিরা চেষ্টা করছি বাই প্রডাক্ট করে ঢাকায় ও ফরিদপুরে বিক্রি করার জন্য। আর দুধের বাজারজাতকরণ বলতে মধ্যস্বত্ত্বভোগি বা মিষ্টির দোকান। তাদের কাছেই বেশিরভাগ দুধ বিক্রি করা হয়। দাম পাওয়া যায় ৪৫ থেকে ৫২ টাকা লিটার। এটা উৎপাদন খরচের থেকে অনেক কম। ৮০ টাকা লিটার হলে লাভ হবে।
তিনি বলেন, দুধ হলো পচনশীল পণ্য। দুধ সংরক্ষণ করে বাজারজাত করতে সরকারের উদ্যোগ আছে। তবে আজও আলোর মুখ দেখেনি। কারণ এখানে দুধের ফ্যাটের ওপর দাম নির্ধারণ করা হয়। সেখানে খামারিদের মধ্যে সমস্যা তৈরি হয়। সরকার বলেছে প্রতিটা ইউনিয়নে চিলিং পয়েন্ট করবে। কিন্তু সেটা কবে করবে তা জানা নেই। আমার ৫৭টি গরু রয়েছে। সেই দুধ সংরক্ষণের জন্য নিজ খরচে এক হাজার লিটারের চিলিং মেশিন আমার রয়েছে। প্রাণিসম্পদ অফিস শুধু প্রশিক্ষণ, ভ্যাকসিন ও স্বপ্ন দেখিয়ে যাচ্ছে। এগুলোর ওপর নির্ভর করে তো একজন খামারি খামার করে না। খামারিদের টিকে থাকতে হলে নিজ উদ্যোগেই টিকে থাকতে হবে।
মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থানার ইমামপুরের ক্ষুদ্র খামারি মো. রাজিব খান বাংলানিউজকে বলেন, ১০ বছর আগে ৪টি গরু দিয়ে খামার শুরু করি। ধীরে ধীরে ২৬টি গরু হয়েছিল। কিন্তু করোনার সময় নানা সমস্যায় ঋণগ্রস্ত হয়ে ১০টি গরু বিক্রি করে দিয়েছি। বর্তমানে ১৩টি গরু আছে। ৩টি গরু ৩০ লিটার দুধ দেয়। দুধের বাজার না থাকায় এলাকায় মিষ্টির দোকান ও চায়ের দোকানে দুধ বিক্রি করি। সর্বোচ্চ ৫০ টাকা লিটার বিক্রি করি। তবে বছরের ৮ মাসই ৪০ টাকা দরে বিক্রি করি। মিষ্টির দোকান না থাকলেতো দুধ ফেলে দিতে হতো। এই এলাকায় দুধের চাহিদা কম। সকলের বাড়িতে দুই চারটি করে গরু রয়েছে। ফলে দুধ বিক্রি করে কোনো লাভ হয় না।
তিনি বলেন, বর্ষার মৌসুমে অনেক সময় দুধ নিয়ে বাইরে যেতে পারি না। তখন দুধ নষ্ট হয়ে যায়। না হলে নাম মাত্র দামে বেচে দিতে হয়। ইমামপুর বাজারে যদি দুধ বিক্রি ব্যবস্থা বা সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকতো তাহলে দুধ বিক্রি করে লাভ করতে পারতাম। প্রাণিসম্পদ অফিসার মাঝে মাঝে এসে খোঁজ খবর নিয়ে যায়। প্রশিক্ষণও দেয়, বাস্তায়ন কিছুই হয় না।
নিজের খামারে দুধসহ আশেপাশের কিছু এলাকার দুধ সংগ্রহ করে বিক্রি করেন নওগাঁ জেলার বরুনকান্দির মো. আলীম। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ মণ দুধ বিক্রি করি। ৫ থেকে ৭টি গ্রাম ঘুরে ৪৫ টাকা লিটার দরে দুধ সংগ্রহ করে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা লিটার দরে মিষ্টির দোকানে বিক্রি করি। অনেক দিন দুধ সংগ্রহ করতে গেলে নষ্ট হয়ে যায়। ফ্রিজিং ভ্যান থাকলে এই সমস্যা হতো না। তাহলে আমি আরও বেশি দুধ সংগ্রহ করতে পারতাম। তবে এ ব্যবসায় এখন আর লাভ হয় না।
তিনি বলেন, আমার খামারে ১৩টি গরু আছে। ৫টি গরু ৪০ থেকে ৪৫ লিটার দুধ দেয়। বর্তমানে গরুর খাবারের দাম বেশি। ফলে প্রতি লিটার দুধ উৎপাদন খরচ পরে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। ফলে গরুর খামারে এখন আর লাভ নেই।
এ বিষয়ে ফরিদপুর জেলার প্রাণিসম্পদ অফিসের উপসহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা এস এম মান্নান বাংলানিউজকে বলেন, ফরিদপুরের প্রায় ২৫ খামারি ২ কোটি ৭২ লাখ টাকা সরকারি অনুদান পেয়েছেন। এখানে ডেইরি, পোল্ট্রিসহ অন্যান্যা খামারি রয়েছেন। এছাড়া আমাদের এখানে ডেইরি অ্যাসোসিয়েশন বা সমিতি রয়েছে, তারা ওইভাবে একটিভ না। আমাদের এখানে যে দুধ হয় সেটা ব্যবস্থাপনার জন্য গতবছর মিল্কভিটা একটি ফিলিং সেন্টার ও প্রসেসিং সেন্টার করার জন্য প্রস্তাব দেয়। কিন্তু পরে তারা এখানে না করে টেকের হাট করেছে। এতে ফরিদপুরের খামারিরা দুধ নিয়ে অনেক বিপাকে পড়েছে। এখন খামারিরা মিষ্টির দোকানে দুধ দিচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা লিটার দরে। কিন্তু যখন উৎপাদন বেশি হয় তখন তারা ৪০ থেকে ৪৫ টাকার বেশি দাম দেয় না।
তিনি বলেন, ফরিদপুর থেকে ঢাকায় কোনোভাবে যদি এই দুধ পাঠানো যেতো, তাহলে দাম স্থিতিশীল থাকতো। ফ্রিজআপ ভ্যানে দুধ পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এছাড়া খামারিদের বাই প্রোডাক্ট হিসেবে দই, ঘি, ছানা, মাওয়া বানানোর পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এটা করা গেলে মিষ্টি দোকানীদের একচেটিয়া আধিপত্য কমতো। এছাড়া সংরক্ষণ, প্রিজারভেশন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাত করণ এই চারটার কোনটাই নেই এখানে।
প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ড. মো. গোলাম রাব্বানী বাংলানিউজকে বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের খামারিরা যাতে সারা বছর দুধ বিপণন করতে পারেন সেজন্য খামারিদেরকে সংগঠিত করতে প্রোভাইডার গ্রুপ করা হচ্ছে। ভিলেজ মিল্ক কালেকশন সেন্টার করবো। মূলত বেসরকারি উদ্যোক্তাদের নিয়ে করা হবে। প্রকল্প থেকে উদ্যোক্তাদের প্রস্তাবনা বিবেচনা করে কালেকশন সেন্টার তৈরিতে মোট খরচের সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ সহায়তা করা হবে। সেখানে খামিরা দুধ দেবে এবং ক্রেতা হবে যারা এখন নিয়মিত দুধ নিচ্ছেন। সরকার আসলে মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে কোন পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেয় না। সরকার এখানেও মূল্য নির্ধারণ করে দেবে না। সরকার চাচ্ছে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের একটি সংযোগ তৈরি করে দিতে।
তিনি বলেন, কালেকশন সেন্টারের সাথে খামারিদের সংগঠন একটি সমঝোতা স্বাক্ষর করবে। সেখানে সব কিছু উল্লেখ থাকবে। সেখানে মূল্য নির্ধারণসহ কতোদিন পরপর দাম পরিবর্তন করবে, কখন দুধ সংরক্ষণ করবে, দুধে ফ্যাটের পরিমাণ কতো সব কিছু থাকবে। আমাদের কর্মকর্তারা এসব কিছু মনিটরিং করে। তবে এতো খামার প্রতি সপ্তাহে ভিজিট করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কিন্তু সরকার ক্যাম্পেইন করে প্রশিক্ষণের আয়োজন করে এবং বিভিন্ন সময়ে ভিজিট করে। ফলে কোন খামারি মনিটরিংয়ের বাইরে নয়। কৃষিখাতে উৎপাদনকারী কখনো পণ্যের দাম নির্ধারণ করতে পারে না। আর মিষ্টি দোকানিদের একচেটিয়া আধিপত্য সেটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। সেখানে আসলে কিছু করার থাকে না। তবে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার জন্য পশুখাদ্য একটি বড় জায়গা সেটা নিয়ে সরকার কাজ করছে।
ড. মো. গোলাম রাব্বানী বলেন, একজন ডেইরি খামারির একমাত্র আয়ের উৎস দুধ বিক্রি হতে পারে না। কিন্তু এখনও আমাদের দেশের খামারিরা দুধ বিক্রিকেই আয়ের উৎস হিসেবে বিবেচনা করে। সরকার অন্য সকল উৎসগুলোকে একটিভ করার জন্য কাজ করে চলেছে। আর বিক্রয় মূল্য বাড়িয়ে খামারিকে লাভের মুখ দেখানো কঠিন। তাহলে ভোক্তা বঞ্চিত হবে। এজন্য আমাদের উৎপাদন খরচ কমিয়ে খামারিদের লাভ দেখাতে হবে। এখানে বড় বিষয় হলো পশু খাদ্য, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্ত হতে হবে তাহলে ব্যয় অনেক কমে যাবে। এজন্য বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণের আয়োজন করে বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে আস্তে আস্তে হলেও এখাতের উন্নয়ন হচ্ছে। হয়তো আমরা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে যেতে পারিনি।
পশুখাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়াকরণ নিয়ে কাজ হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার মেচিংগ্রান্ট দেওয়ার মাধ্যমে কিছু সহযোগিতা করবে। সেটার প্রভাব হতো বাজারে আসবে। সেই সহায়তা সরাসরি টাকা দিয়ে নয়, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেব আমরা, যা কোনোদিন সরকারকে ফেরত দিতে হবে না। একটা পর্যায়ে সবকিছুর মালিক হবেন উদ্যোক্তাই। আমরা ঘোষণা দিয়ে কেস বাই কেস এটি হ্যান্ডেল করবো। এটি মূল্যায়নের জন্য আমাদের সঙ্গে ইন্টারন্যাশন এগ্রি বিজনেস থাকবে। তারা তাদের গ্লোবাল নলেজ দিয়ে সাপোর্ট দেবে। আশা করছি এভাবে দেশে দুধের উৎপাদন ২০ শতাংশ বৃদ্ধি করা সম্ভব।
এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা বাংলানিউজকে বলেন, আমরা চাই খামারিরা যেন নিশ্চিত হতে পারে তাদের উৎপাদিত দুধ তারা নিজেরাই বিক্রি করতে পারবে। সে সুযোগ তৈরি হলে কিন্তু খামারিরা উৎপাদনও বাড়াবে। উৎপাদিত দুধ যদি সহজে ও ন্যায্য দামে বেচতে না পারে তখন তো তারা উৎপাদনে আগ্রহ হারাবে। সেজন্য আমরা পাঁচ হাজার পাঁচশোটি গ্রুপ তৈরি করেছি, যার মাধ্যমে আমাদের এ প্রক্রিয়া শুরু হবে। আমরা কাজ করছি ভবিষ্যতেকে কেন্দ্র করে। দুধ পাওয়া যায় না, এমন পরিস্থিতি তো আমাদের সৃষ্টি হয়নি। ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায় ক্রেতা বাড়ছে, মানুষ স্বাস্থ্য সচেতন হচ্ছে। সেক্ষেত্রে সামনের দিনগুলোর কথা মাথায় রেখেই আমরা কাজ করছি।
এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বাংলানিউজকে বলেন, দেশের প্রাণিসম্পদ খাতের প্রান্তিক খামারিদের কথা বিবেচনা করে সরকার নানা কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে তাদের ঋণ প্রদান করা হচ্ছে। বিভিন্নভাবে তাদের অনুদান দেওয়া হচ্ছে। দুধ সংগ্রহ ও বিপণনের সীমিত উদ্যোগের কারণে অনেক সময় প্রান্তিক খামারিরা দুধের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
তিনি বলেন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে দুধের সরবরাহ ও বিপণন ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। এ প্রকল্পের আওতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ৩০০টি ভিলেজ মিল্ক কালেকশন সেন্টার (ভিএমসিসি) স্থাপন করা হচ্ছে। আঞ্চলিক পর্যায়ে ডেইরি হাব স্থাপনের বিষয়েও কাজ চলছে। তাছাড়া খামারিদের সংগঠিত করে বিভিন্ন ডেইরি গ্রুপ তৈরি করা হচ্ছে। ডেইরি গ্রুপগুলো থেকে উৎপাদিত দুধ যাতে বিপণন চ্যানেলে প্রবেশ করতে পারে, সেজন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মিল্ক কুলিং সেন্টার ও দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট স্থাপন করা হচ্ছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে দুধের মূল উৎস গরু। ৯০ শতাংশ দুধ আসে গরু থেকে, আট শতাংশ আসে ছাগল থেকে এবং দুই শতাংশ আসে মহিষ থেকে। ১৯৮৯-৯০ থেকে ২০০১-০২ অর্থবছর পর্যন্ত দুধের উৎপাদন বৃদ্ধির হার ২.৪ শতাংশ, ২০০৯-১০ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত দুধের উৎপাদন বৃদ্ধির হার ১৬.৪৪ শতাংশ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে দুধের উৎপাদন ছিল ২৩.৭০ লাখ টন, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে উন্নীত হয়েছে ১০৬.৮০ লাখ টনে। বর্তমানে মাথাপিছু দৈনিক ২৫০ মিলিলিটার দুধের চাহিদার বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে ১৯৩.৩৮ মিলিলিটার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৫২.০২ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে দুধ উৎপাদন হয় ১০৬.৮০ লাখ টন। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে মোট চাহিদা ১৫৪.৯৪ লাখ মে.টন বিপরীতে উৎপাদন ১১৯.৮৫ লাখ মে.টন। জন প্রতি প্রাপ্যতার দিক দিয়ে দিনে ১৯৩.৩৮ মিলি। এ হিসাবে দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ১৩.০৫ লাখ মে.টন।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২২
জিসিজি/এসএ