ঢাকা, শুক্রবার, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বসুন্ধরা শুভসংঘ

যাকাত, ফিতরা ও ওশর সম্পর্কিত মাসলা মাসায়েল

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৬ ঘণ্টা, মে ৮, ২০২০
যাকাত, ফিতরা ও ওশর সম্পর্কিত মাসলা মাসায়েল

এক.
ইসলাম সর্বজনীন ধর্ম। ইসলাম হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। মানবজীবনের সব সমস্যার সার্থক সমাধান রয়েছে ইসলামে। সমাজে ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় আল্লাহ মানব জাতির কল্যাণ বাতলে দিয়েছেন।

ইসলামে দান-খয়রাতের নানা মাত্রিক ধরন রয়েছে। সাদাকা ইফাক ফী সাবিলিল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয়।

সব ধরনের দানই আল্লাহর রাস্তায় ব্যয়।

দানকে ফরজ করে বিধান চালু হয় হিজরতের পর। একে বলা হয় যাকাত। যাকাত শব্দের অর্থ পবিত্রতা ও বৃদ্ধি। যাকাতের নিসাব ও ফিতরার নিসাব সমান হলেও ধন-সম্পদের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। যাকাতের ক্ষেত্রে নিসাব পরিমাণ ধন-সম্পদ পূর্ণ এক বছরকাল স্থায়ী হলে সেই সাহিবে নিসাবের উপরে যাকাত বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। শতকরা আড়াইভাগ হিসাব করে যাকাত দেওয়া, কিন্তু ফিতরার ক্ষেত্রে পূর্ণ এক বছরকাল স্থায়ী হবার প্রয়োজন হয় না বরং ঈদ-উল-ফিতরের দিন সকালে নিসাব পরিমাণ ধন-সম্পদের অধিকারী হলেই তার ওপর ফিতরা ওয়াজিব হয়ে যায়।

সাদকাতুল ফিতর শুধু মাত্র রমজান মাসে রোজাদরদের ভুল-ত্রুটি ইত্যাদি’র কাফ্ফারা হিসেবে দিতে হয়। আর যাকাত অর্জিত সম্পদের বাৎসরিক হিসাবের উপর নির্ধারিত হয়। যাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তন করে মানবজাতির অর্থনৈতিক সমস্যার সার্থক সমাধানের পথ সুগম করে দিয়েছে শাশ্বত সুন্দর ও সত্য-ন্যায়ের ধর্ম ইসলাম।  এ পর্যায়ে আমরা ফিতরা নিয়ে আলোচনা করবো।

ইসলামী শরিয়তের বিধান মোতাবেক এটি একটি ওয়াজিব আমল। ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় জীবিকা নির্বাহের অত্যাবশকীয় সামগ্রী ছাড়া নিসাব পরিমাণ বা অন্য কোনো পরিমাণ সম্পদের মালিকদের পক্ষ থেকে গরিবদের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণের একটি অর্থ প্রদান করার বিশেষ আয়োজনকে সাদকাতুল ফিতর বলা হয়। ইসলামী শরিয়াহ মতে আটা, খেজুর, কিসমিস, পনির, যব ইত্যাদি পণ্যগুলোর যে কোনো একটি দিয়ে ফিতরা দেওয়া যায়। আটা দিয়ে ফিতরা আদায় করলে অর্ধ সা’বা ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম বা এর সর্বোচ্চ বাজার মূল্য ৭০ টাকা দিতে হবে। যব দিয়ে আদায় করলে এক সা’বা ৩ কেজি ৩শ গ্রাম বা এর সর্বোচ্চ বাজার মূল্য ২৭০ টাকা, গম দিয়ে আদায় করলে অর্ধ সা’ বা ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম বা এর সর্বোচ্চ বাজার মূল্য ৭০ টাকা, কিসমিস দিয়ে আদায় করলে এক সা’বা ৩ কেজি ৩শ গ্রাম বা এর সর্বোচ্চ বাজার মূল্য ১৫শ টাকা, খেজুর দিয়ে আদায় করলে এক সা’ বা ৩ কেজি ৩শ গ্রাম বা এর সর্বোচ্চ বাজার মূল্য ১৬৫০ টাকা, পনির দিয়ে আদায় করলে এক সা’ বা ৩ কেজি ৩শ গ্রাম বা এর সর্বোচ্চ বাজার মূল্য ২২শ টাকা ফিতরা দিতে হবে।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে দেশের শীর্ষ পর্যায়ের আলেম ওলামাদের সমন্বয়ে দেশের সব বিভাগ থেকে সংগৃহীত আটা, যব, গম, কিসমিস, খেজুর ও পনিরের সর্বোচ্চ বাজার মূল্যের ভিত্তিতে ফিতরা নির্ধারণ করা হয়েছে। মুসলমানরা নিজ নিজ সামর্থ অনুযায়ী উপরোক্ত পণ্যগুলোর যেকোনো একটি পণ্য বা এর বাজার মূল্য দ্বারা সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে পারবেন। পণ্যগুলোর স্থানীয় খুচরা বাজারমূল্যের তারতম্য রয়েছে। তদানুযায়ী স্থানীয় মূল্যে পরিশোধ করলেও ফিতরা আদায় হবে।

ফিতরার জন্য নির্ধারিত নিসাবের অধিকারীকে ফিতরার জন্য নির্ধারিত মাথাপিছু হিসেবে গরিব-মিসকিনদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। সাহিবে নিসাব নিজের পরিবারের নাবালিগ সন্তানাদি, গৃহভৃত্য সবার ফিতরা তিনি আদায় করবেন। এমনকি ঈদ-উল-ফিতরের দিন সকাল বেলার পূর্বে যদি কোনো সন্তান জন্মগ্রহণ করে তারও ফিতরা আদায় করবেন। ঈদের দিন সকালে ঈদের সালাত আদায় করতে যাওয়ার পূর্বে ফিতরা দেওয়া উত্তম।

ফিতরার মাধ্যমে রমজানের সিয়ামের মধ্যে যদি কোনো অনিচ্ছাকৃত ছোটখাটো ত্রুটিবিচ্যুতি হয়ে থাকে তার প্রায়শ্চিত্ত সঞ্চিত হয়। কোরআনে বলা হয়েছে, তোমরা নেকী ও পরহেযগারীর মধ্যে সাহায্য করো। আর পাপ ও শত্রুতা অর্থাৎ আল্লাহ ও তার রসুল (সা.) এর বিরোধিতা বা নাফরমানীর মধ্যে সাহায্য করো না। এ বিষয়ে তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা। (সূরা মায়িদা: আয়াত-২)

ইবনু আব্বাস (রা.) বর্ণিত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, যাকাতুল ফিতর ফরজ করা হয়েছে অশ্লিল কথা ও খারাপ কাজ হতে রোজাকে পবিত্র করতে এবং মিসকিনদের খাদ্যের জন্য। যে ব্যক্তি ঈদের সলাতের (নামাযের) পূর্বে তা আদায় করে সেটা কবুল সদকাহ গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি সালাতের পর তা আদায় করবে তা সাধারণ দান হিসেবে গৃহীত হবে। (আবু দাউদ, ১ম খন্ড,হা/১৬০৯; ইবনু মাজাহ,হা/১৮২৭)

দুই.

এ পর্যায়ে যাকাতের বিষয়টি খতিয়ে দেখবো। ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিধান হচ্ছে যাকাত আদায়। পবিত্র কোরআন শরীফের বহু স্থানে সালাতের আদেশের সঙ্গে যাকাত আদায়ের আদেশ দেওয়া হয়েছে। যাকাত ফরয হবার বহু পূর্বে দান করার অর্থে যাকাত দেবার নির্দেশ নাযিল হয়। এরশাদ হচ্ছে, ‘সালাত কায়েম করে যাকাত প্রদান করো এবং আল্লাহকে দাও উত্তম ঋণ (কর্যে হাসানা) তোমরা তোমাদের মঙ্গলের জন্য অগ্রিম যা কিছু প্রেরণ করবে তোমরা পাবে আল্লাহর নিকট। ওটাই উৎকৃষ্টতর এবং পুরস্কার হিসেবে মহত্তর। আর তোমরা ক্ষমা চাও আল্লাহর নিকট। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। ’ (সূরা মুয়াজ্জিম : আয়াত ২০)।

যাকাত আরবি শব্দ। যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি (growth), পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা ও পরিশুদ্ধি। যাকাতের নির্ধারিত বিধান নাযিল হয় হিজরতের পরে। সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় কিংবা সাদাকা অর্থে দান খয়রাত করতেন। কিন্তু সেসব দানের মধ্যে ছিল সওয়াব লাভের প্রবল আকাঙ্ক্ষা। কত পরিমাণ দান করতে হবে তার নির্দিষ্ট কোনো হার ছিল না।

এর বহু পরে সূরা তওবার ১০৩ নম্বর আয়াত নাযিল হলে যাকাত আদায় ও খাতওয়ারি ব্যয় করার বিধান বলবত হয়। সূরা তওবার ৬০ নম্বর আয়াতে যাকাত ব্যয় করার ৮টি খাত নির্ধারিত করে বিধান নাযিল করা হয়। এখানে লক্ষণীয় এতে যাকাতকে সাদাকাত বলা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ এরশাদ করেন, ‘সাদাকা (যাকাত) তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণভারাক্রান্তদের জন্য, আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান, আল্লাহ সব জানেন, প্রজ্ঞাময়। (সূরা তওবা : আয়াত ৬০)।

যাকাত সালাতের মতোই ফরজ এবাদত। ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (র.) এর আমলে ভণ্ড নবীদের একটা গ্রুপ যাকাত না দেওয়ার পক্ষে প্রচারণা চালালে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! যে ব্যক্তি সালাত ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে, আমি তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবো। ’(বুখারি শরীফ), (মুসলিম শরীফ)।

যাকাতের নিসাবের পরিমাণ হচ্ছে সাড়ে সাত তোলা সোনা অর্থাৎ ৮৭.৪৫ গ্রাম সোনা অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য অর্থাৎ ৫১২.১৫ রৌপ্য অথবা ওই পরিমাণ সোনা বা রৌপ্যের দামের অর্থ অথবা সম্পদ। খাতের বাইরে অন্য কোনো খাতে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে না। নিম্নে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত উলেস্নখিত ৮টি খাতের বর্ণনা দেয়া হলো।

যাকাত বণ্টনের নির্ধারিত ৮টি খাতের বিবরণ:

প্রথম খাত: ফকীর- ফকীর হলো সেই ব্যক্তি যার নিসাব পরিমাণ সম্পদ নেই। যে ব্যক্তি রিক্তহস্ত, অভাব মেটানোর যোগ্য সম্পদ নেই, ভিক্ষুক হোক বা না হোক, এরাই ফকীর। যে সকল স্বল্প সামর্থ্যের দরিদ্র মুসলমান যথাসাধ্য চেষ্ট করা সত্ত্বেও বা দৈহিক অক্ষমতাহেতু প্রাত্যহিক ন্যায়সঙ্গত প্রয়োজনটুকু মেটাতে পারে না, তারাই ফকীর। কারও মতে যার কাছে একবেলা বা একদিনের খাবার আছে সে ফকীর।

 

দ্বিতীয় খাত: মিসকীন- মিসকীন সেই ব্যক্তি যার কিছুই নেই, যার কাছে একবেলা খাবারও নেই। যে সব লোকের অবস্থা এমন খারাপ যে, পরের নিকট সওয়াল করতে বাধ্য হয়, নিজের পেটের আহারও যারা যোগাতে পারে না, তারা মিসকীন। মিসকীন হলো যার কিছুই নেই, সুতরাং যার কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ অর্থ সম্পদ নেই, তাকে যাকাত দেওয়া যাবে এবং সেও নিতে পারবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, ফকীর বা মিসকীন যাকেই যাকাত দেয়া হবে, সে যেন মুসলমান হয় এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক না হয়।

তৃতীয় খাত: আমেলীন-  ইসলামী সরকারের পক্ষে লোকদের কাছ থেকে যাকাত, উসর প্রভৃতি আদায় করে বায়তুল মালে জমা প্রদান, সংরক্ষণ ও বন্টনের কার্যে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ। এদের পারিশ্রমিক যাকাতের খাত থেকেই আদায় করা যাবে। কুরআনে বর্ণিত আটটি খাতের মধ্যে এ একটি খাতই এমন, যেখানে সংগৃহীত যাকাতের অর্থ থেকেই পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। এ খাতের বৈশিষ্ট্য হলো এতে ফকীর বা মিসকীন হওয়া শর্ত নয়। পক্ষান্তরে, অবশিষ্ট ৫টি খাতে দরিদ্র ও অভাবগ্রস্থ দূরীকরণে যাকাত আদায় শর্ত।

 

চতুর্থ খাত: মুআলস্নাফাতুল কুলুব (চিত্ত জয় করার জন্য)- নতুন মুসলিম যার ঈমান এখনও পরিপক্ক হয়নি অথবা ইসলাম গ্রহণ করতে ইচ্ছুক অমুসলিম। যাদের চিত্ত (দ্বীন ইসলামের প্রতি আকর্ষণ করে) আকর্ষণ ও উৎসাহিত করণ আবশ্যকীয় মনে করে যাকাত দান করা হয়, যাতে তাদের ঈমান পরিপক্ক হয়। এ খাতের আওতায় দুঃস্থ নওমুসলিম ব্যক্তিদের যাকাত প্রদানের ব্যাপারে ফকিহগণ অভিমত প্রদান করেছেন।

পঞ্চম খাত: ক্রীতদাস/বন্দি মুক্তি- এ খাতে ক্রীতদাস-দাসী/বন্দি মুক্তির জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে। অন্যায়ভাবে কোনো নিঃস্ব ও অসহায় ব্যক্তি বন্দি হলে তাকেও মুক্ত করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে।

ষষ্ঠ খাত: ঋণগ্রস্ত-  এ ধরণের ব্যক্তিকে তার ঋণ মুক্তির জন্য যাকাত দেয়ার শর্ত হচ্ছে- সেই ঋণগ্রস্তের কাছে ঋণ পরিশোধ পরিমাণ সম্পদ না থাকা। আবার কোনো ইমাম এ শর্তারোপও করেছেন যে, সে ঋণ যেন কোন অবৈধ কাজের জন্য- যেমন মদ কিংবা না- জায়েয প্রথা অনুষ্ঠান ইত্যাদির জন্য ব্যয় না করে।

সপ্তম খাত: আল্লাহর পথে- সম্বলহীন মুজাহিদের যুদ্ধাস্ত্র/সরঞ্জাম উপকরণ সংগ্রহ এবং নিঃস্ব ও অসহায় গরীব দ্বীনি শিক্ষারত শিক্ষার্থীকে এ খাত থেকে যাকাত প্রদান করা যাবে। এ ছাড়াও ইসলামের মাহাত্ম্য ও গৌরব প্রচার ও প্রসারের কাজে নিয়োজিত থাকার কারণে যারা জীবিকা অর্জনের অবসর পান না এবং যে আলিমগণ দ্বীনি শিক্ষাদানের কাজে ব্যাপৃত থাকায় জীবিকা অর্জনের অবসর পান না। তারা অসচ্ছল হলে সর্বসম্মতভাবে তাদেরও যাকাত দেওয়া যাবে।

অষ্টম খাত: অসহায় মুসাফির- যে সমস্ত মুসাফির অর্থ কষ্টে নিপতিত তাদেরকে মৌলিক প্রয়োজন পুরণ হওয়ার মত এবং বাড়ী ফিরে আসতে পারে এমন পরিমাণ অর্থ যাকাত থেকে প্রদান করা যায়।

তিন.

যাকাত ব্যবস্থা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে সমাজে দারিদ্র্য থাকবে না। সম্পদের যাকাত আদায় করা ফরজ। অন্যান্য সম্পদের ন্যায় ভূমি থেকে উৎপাদিত ফসলের ও নির্ধারিত যাকাত রয়েছে। এটা আদায় করা ফরজ। শরীয়তের পরিভাষায়-ফসলের যাকাতকে ‘উশর’ বা ‘খিরাজ’ বলে। অর্থাৎ জমি উশরী হলে যা আদায় করতে হবে তা ‘উশর’। আর জমি খিরাজী হলে যা আদায় করতে হবে তা ‘খিরাজ’। মুসলমানের মালিকাধীন ভূমিই হচ্ছে উশরী ভূমি। ‘উশর’ এর অভিধানিক অর্থ হচ্ছে-একদশমাংশ। মুসলমানের মালিকানাধীন ভূমি থেকে উৎপাদিত ফসলের একদশমাংশ বা দশ ভাগের এক ভাগ অথবা একদশমাংশের অর্ধেক তথা বিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দেওয়াকে ‘উশর’ বলে। অর্থাৎ মুসলমানের মালিকানাধীন যেসব জমিকে বৃষ্টির পানি এবং নদীর পানি সিক্ত করে কিংবা স্বভাবতই সিক্ত থাকে-এমন জমি থেকে উৎপাদিত ফসলের দশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হবে। যেসব জমিকে সেচের মাধ্যমে সিক্ত করা হয়-এমন জমি উৎপাদিত ফসলের বিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হবে। অন্যান্য সম্পদের যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে নিসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বছর মালিকানাধীন থাকা শর্ত কিন্তু ফসলের যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে সেই ফসল এক বছর মালিকানাধীন থাকা শর্ত নয়। বরং যখনই ফসল হস্তগত হবে তখনই উশর আদায় করতে হবে। এমনকি বছরে যতবার ফসল উৎপাদন হবে ততবারই ফসলের দশভাগের এক ভাগ যাকাত হিসেবে আদায় করতে হবে।

ফসলের যাকাত আদায় করা ফরজ। এ বিষয়টি পবিত্র কোরআন দ্বারা সুস্পষ্ট প্রমাণিত। এরশাদ হচ্ছে-‘তার ফসল উৎপাদিত হলে তা তোমরা খাও এবং ফসল কাটার দিনই তার হক আদায় করো। ’ (সূরা আনআম : আয়াত-১৪১)।

ফসলের যাকাত হচ্ছে ‘উশর’। অন্য আয়াতে এরশাদ হচ্ছে-‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা উপার্জন কর এবং আমি যা ভূমি থেকে তোমাদের জন্য বের করে দেই তন্মধ্যে যা উৎকৃষ্ট তা ব্যয় করো। ’ (সূরা বাকারা : আয়াত-২৬৭)।

‘উশর’ এর যাকাত সম্পর্কে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) এরশাদ করেন-‘যে জমিকে বৃষ্টির পানি অথবা নদীর পানি সিক্ত করে অথবা স্বভাবতই সিক্ত হয় তাতে ‘উশর’ অর্থাৎ দশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হবে। আর যে জমিকে সেচের মাধ্যমে সিক্ত করা হয় তাতে ‘অর্ধ উশর’ অর্থাৎ বিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হবে (বুখারী-১ম খণ্ড : পৃষ্ঠা-২০১, মিশকাত শরীফ : পৃষ্ঠা-১৫৯)।

যে জমিতে পরিশ্রম করে পানি সেচের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করা হয়-সেসব জমির উৎপাদিত ফসলের বিশ ভাগের এক ভাগ (বিশ মন হলে এক মন) উশর হিসেবে দিতে হবে।

উশর এর নিসাব বা পরিমাণ বা উশর আদায় নিয়ে ইমামদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ইমাম আবু হানিফা (র.)-এর মতে-উশর এর নির্ধারিত কোনো নিসাব নেই। যে পরিমাণ ফসলই উৎপাদন হোক না কেন উশর (দশ ভাগের এক ভাগ) আদায় করতে হবে। হানাফী ফিকহের কিতাবাদীতে উশর এর নিসাবের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফার মতের পক্ষে ফতোয়া বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হানাফী মাযহাবের ইমামগণের মধ্যে ইমাম আবু ইউসুফ (র.) ও ইমাম মুহাম্মদ (র.)-এর মতে-উশর এর নিসাবের পরিমাণ পাঁচ ওসাক (প্রচলিত মাপে ৯৪৮ কেজি)। অর্থাৎ ফসলের পরিমাণ ৯৪৮ কেজি হলে উশর (দশ ভাগের এক ভাগ) আদায় করতে হবে-এর কম হলে উশর আদায় করতে হবে না। কোনো কোনো কিতাবে মুতাআখখিরীনদের মতে-ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ (র.)-এর মতকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। উশরী ভূমিতে উৎপাদিত ধান, গম ইত্যাদির মত ফলমূল, শাক-সবজিরও উশর দিতে হবে। প্রাপ্ত ফসলের দশ ভাগের এক ভাগ বা এর বাজার মূল্য দিয়েও উশর আদায় করতে পারবে। বর্গা চাষের ক্ষেত্রে জমির মালিক এবং চাষি প্রাপ্ত ফসলের নিজ নিজ অংশের উশর আদায় করতে হবে। তাই যাকাতে উশর বাস্তবায়নে এগিয়ে আসা আমাদের সকলের উচিত।

যাকাত যাদের দেওয়া যাবে না:

১। উলামায়ে ছূ’ বা ধর্মব্যবসায়ী মাওলানা দ্বারা পরিচালিত মাদরাসা অর্থাৎ যারা জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও অন্যান্য কুফরি মতবাদের সাথে সম্পৃক্ত সেই সমস্ত মাদরাসাতে যাকাত প্রদান করলে যাকাত আদায় হবে না।

২। নিসাব পরিমাণ মালের অধিকারী বা ধনী ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া যাবে না।

৩। মুতাক্বাদ্দিমীন অর্থাৎ পূর্ববর্তী আলিমগণের মতে কুরাঈশ গোত্রের বনু হাশিম-এর অন্তর্গত হযরত আব্বাস, হযরত জাফর, হযরত আকীল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনাদের বংশধরের জন্য যাকাত গ্রহণ বৈধ নয়। তবে মুতাআখখিরীন অর্থাৎ পরবর্তী আলিমগণের মতে বৈধ।

৪। অমুসলিম ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া যাবে না।

৫। যে সমস্ত মাদরাসায় ইয়াতীমখানা ও লিল্লাহ বোডিং আছে সেখানে যাকাত দেয়া যাবে এবং যে সমস্ত মাদরাসায় লিল্লাহ বোডিং নেই সেখানে যাকাত দেয়া যাবে না।

৬। দরিদ্র পিতামাতাকে, সন্তানকে, স্বামী বা স্ত্রীকে যাকাত দেওয়া যাবে না।

৭। প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ইয়াতীমখানা লিল্লাহ বোডিংয়ের জন্য যাকাত আদায়কারী নিযুক্ত হলে তাকে যাকাত দেওয়া যাবে না।

৮। উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যদি উপার্জন ছেড়ে দিয়ে নামাজ-রোজা ইত্যাদি নফল ইবাদতে মশগুল হয়ে যায় তাকে যাকাত দেওয়া যাবে না। তবে সে যদি উপার্জন না থাকার কারণে যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত হয় তবে যাকাত দেওয়া যাবে।

৯। বেতন বা ভাতা হিসেবে নিজ কর্মচারী, কর্মচারিণী বা কাজের পুরুষ ও মহিলাদেরকে যাকাতের টাকা দেওয়া যাবে না।

পরিশেষে বলবো, যাকাত বর্তমানের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় আয়কর নয় বা গরিবের প্রতি দয়ার দানের বিষয় নয়। এটি ধনীর সম্পদে গরিবের অধিকার। যা আল্লাহ বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন। ফিতরাও এক ধরনের যাকাত। যাকে সাদাকাতুল ফিতরও বলা হয়। পবিত্র রমজানের শেষে ফিতরা ওয়াজিব হয়ে যায় শরীয়তের বিধান অনুসারে। নির্দিষ্ট করে দেওয়া নির্দিষ্ট পরিমাণ ধন-সম্পদের অধিকারীর ওপর অর্থাৎ সাহিবে নিসাবের উপর। আল্লাহ আমাদের প্রত্যেককে সদাকাতুল ফিতর, যাকাত-ওশর এর উপর কোরআান ও হাসিসের আলোকে আমল করার তৌফিক এনায়েত করুন।  

লেখক: উপ-পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ইমেইল- bellalbinquashem@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ১৬০৬ ঘণ্টা, মে ০৮, ২০২০
এইচএডি/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।