ঢাকা: ২০১০ সালে জাভি-ইনিয়েস্তারা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বিশ্বকাপ জয় করে নিয়ে যাওয়ার পর বার্সেলোনা সতীর্থ মেসি তাদের আড়ালে ডেকে জানতে চেয়েছিলেন সোনালি ওই ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখতে কেমন লাগে?
বোবা অনূভূতি সতীর্থকে বোঝাতে পারেননি জাভি-ইনিয়েস্তা। জন্মের পর অবধি আলবিসেলেস্তেদের শোকেসে বিশ্বকাপ ট্রফি না দেখে মেসির নিজেরও কোনো উপলদ্ধি ছিলনা।
উপলদ্ধি না থাকারই কথা তার। ৮৬ বিশ্বকাপে ২৬ বছরের ঝাঁকড়া চুলের খ্যাপাটে এক যুবক মেক্সিকো থেকে একার জোরেই সোনালি ট্রফি নিয়ে ফিরেছিলেন বুয়েন্স আয়ার্সে।
মেসি তা দেখেননি। তখন তিনি মাতৃগর্ভে। তবু শৈশব থেকে বর্তমান পর্যন্ত খ্যাপাটে ওই যুবকের গগণপানে তুলে ধরা সোনালি ট্রফির ছবিই মনে লাখো বার একেছেন।
৯০ বিশ্বকাপের ফাইনাল হেরে ওই যুবকের বিদায় তিনি দেখেননি। তখন মেসির বয়স মাত্র ৩। তবু অল্পের জন্য তৃতীয় বিশ্বকাপ হারানোর বেদনার ক্ষত তিনি শৈশব থেকেই বয়ে বেড়াচ্ছেন।
সেইসব সুখ স্মৃতি আর অতৃপ্ততায় মেসি পণ করেছিলেন তিনি নিজেই একদিন ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখবেন। দেখবেন এতে রক্তপ্রবাহ একমুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে যায় কিনা, কিংবা শরীরে কি অজানা শিহরণ জাগে!
সময়ের পরিক্রমায় ফুটবল মেসিকে দিয়েছে সব। মেসিও ফুটবলকে দিয়েছেন অঢেল। খ্যাপাটে সেই নায়ক ম্যারাডোনার কাছ থেকে পেয়েছেন সেরার মর্যাদা।
দুর্বার তারুণ্যে দুই দুইটি বিশ্বকাপে নিজেকেও জানান দিলেও বুভুক্ষু ট্রফির নাগাল মেলেনি মেসির। এবার ব্রাজিল এসেছেন অভিজ্ঞ ও পোড় খাওয়া মেসি হয়ে।
পেছনে রেখে এসেছেন টানা চারটি ব্যালন ডি’অর ও ক্লাব ফুটবলের সম্ভাব্য সব অর্জন। ২৮ বছরের শাপ মোচনে তার হাতেই বেঁধে দেওয়া হয়েছে দলপতির স্মারক।
এবার তিনি পারবেন, বিশ্বাস আলবিসেলেস্তেদের। বিশ্বাস ম্যারাডোনার, কোটি ভক্ত-সমর্থকদের। এমনটি ফুটবল বিধাতারও। নয়ত নক্ষত্রে ভরা আর্জেন্টিনাকে কেন একা মেসির পায়ের জাদুতেই সেমিফাইনাল পর্যন্ত আসতে হবে। হিগুয়েন-মারিয়া-অ্যাগুয়েরো থাকলেও কেন মেসিকেই তার জাদুর ঝাঁপি খুলে বসতে হবে রোজ রোজ?
৯০ বিশ্বকাপের ফাইনালে ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা হারার পর কে ভেবেছিল দুই যুগের জন্য অস্তমিত হতে যাচ্ছে আর্জেন্টিনার ফাইনাল বা সেমিফাইনালে ওঠা।
তারও বছর চারেক আগে ৮৬’তে ম্যারাডোনার একার কাঁধে ভর করে বিশ্বকাপ এল ল্যাটিন আমেরিকার দেশটিতে। তখনই বা কে ভেবেছিল ২৮ বছরের জন্য ধুলি জমা পড়তে যাচ্ছে শিরোপা জয়ের মিশনে।
কেউ ভাবেনি। শুধু অন্তযার্মী ভেবে রেখেছিলেন। মেসি নামের এক তরুণ তুর্কির হাতেই ২৭ বছর পর আর্জেন্টাইনদের বিজয়গাঁথা লিখবেন বলে।
এবার এসেছে সেই লগ্ন। ম্যারাডোনা-পেলেকে ছাড়িয়ে ফুটবলের সর্বোচ্চ আসন দখল করতে মেসির আর মাত্র ১৮০ মিনিটের অপেক্ষা। এর পর তিনি পুনরুদ্ধার করবেন ২৪ বছর আগের হারানো রাজ্য। ফিরিয়ে আনবেন ২৮ বছর আগের হৃত গৌরব। তার নাম দিয়েই হয়তো মীমাংসা হবে সেরা ফুটবলারের বিতর্ক।
বুধবার বাংলাদেশ সময় রাত ২টায় ব্রাজিলের সাও পাওলোর অ্যারেনা করিন্থিয়ানসে হল্যান্ডকে হারিয়ে মেসি জয় করে নেবেন সব। এমন প্রত্যশা ও প্রার্থনায় মগ্ন কোটি কোটি আকাশি-সাদা ভক্ত সমর্থকরা।
তবে হল্যান্ডের ম্যাচে আগেও মেসিদের সামনে আসছে ৩৬ বছরের পুরোনা ধুলা জমা এক ইতিহাস। ১৯৭৮ সালের ফাইনালে আকাশি-সাদাদের প্রথম মহানায়ক সিজার মেনোত্তির হাত ধরেই ফাইনালে হল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথম চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা।
আজ ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে সেই হল্যান্ড। ওই প্রথম জয়ের পরে বিশ্বকাপের মঞ্চে টোটাল ফুটবলের দেশ হল্যান্ডকে আর হারাতে পারেনি আর্জেন্টিনা। ৯৮ বিশ্বকাপে প্যাসারেলার আর্জেন্টিনা, ২০০৬ বিশ্বকাপে পেকারম্যানের আর্জেন্টিনাকে রুখে দিয়েছে হল্যান্ড।
২০১৪’তে সাবেলার আর্জেন্টিনাকেও রুখে দেওয়ার ঘোষণা এসেছে রোবেন পার্সিদের কাছ থেকে। তবে সাবেলার ভাণ্ডাড়ে মেসি ম্যাজিক রয়েছে বলেই মেনোত্তির পর হল্যান্ড বধের স্বপ্ন দেখছে আর্জেন্টিনা।
এর বাইরেও ইতিহাস বারবার মেসিকে নিয়ে যাচ্ছে ৮৬’র ম্যারাডোনার পাশে। প্রায় প্রতিটি বিষয়ে মিলিয়ে দিচ্ছে দুজনকে। ভক্তদের প্রত্যাশা ১৩ জুলাই মারাকানার ট্রফিটা উচিয়ে ধরে মেসি ছাড়িয়ে যাবেন সব পরিসংখ্যানের বাধা।
তার চেয়েও বড় প্রেরণা হয়ে মেসিদের সামনে এসেছে ৯ জুলাই। দিনটি আর্জেন্টিনার স্বাধীনতা দিবস। ১৯৬ বছর আগে অসংখ্য আর্জেন্টাইন যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলেন। একইদিনে আবারও আর্জেন্টিনা ফুটবলের হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধারের চুড়ান্ত লড়াইয়ে নামছেন মেসিরা।
অমরত্বের সুধা পান করতে মেসির সামনে আজ হল্যান্ড এবং ১৩ জুলাই জার্মানি। মাত্র ১৮০ মিনিটের প্রতীক্ষা মেসি ম্যাজিকের। স্বাধীনতা দিবসের মন্ত্রে উজ্জীবিত ম্যারাডোনার অনুজরা ২৮ বছরের শাপ মোচনের অন্তি মুহূর্তে পা রাখবেন আজই সে ভরসায় ফুটবলপ্রেমীরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪২ ঘণ্টা, জুলাই ০৯, ২০১৪