সিলেট: দখল স্বত্ত্বে বিক্রি করা হচ্ছে সিলেটের তারাপুর চা বাগানের ভূমি। বিক্রিত ভূমিতে গড়ে ওঠেছে বসতি।
গোপনে দখলীয় স্বত্ত্বে এসব ভূমি বিক্রির অভিযোগের তীর বাগান ম্যানেজার রিংকু চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে।
বাগান সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দাদের অনেকে জানান, ম্যানেজার রিংকু চক্রবর্তীর কাছ থেকে জমি কিনে তারা বাড়ি তৈরি করেছেন। কেউ কেউ বলেন, টাকা দিয়ে তারা ৯০ বছরের জন্য বাগানের জায়গা ইজারা নিয়ে বসতি গড়েছেন।
তাদের অনেকে টাকার পরিমাণ উল্লেখ করে বলেন, রিংকু চক্রবর্তীর কাছ থেকে নগদ অর্থে ভূমির মালিক হয়েছেন। ক্রয়কৃত এসব ভূমি আবার বিক্রি করতে অনেকে সাইনবোর্ড টানিয়ে রেখেছেন। চা বাগানের ভূমি রক্ষায় এরই মধ্যে আদালত থেকে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়। কিন্তু বাগান ব্যবস্থাপক কমিটিকে ফাঁকি দিয়ে নিজেই দখল স্বত্ত্বে ভূমি বিক্রি করে কাড়ি কাড়ি টাকা তুলে নিয়েছেন।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগে আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর দখলদারিত্বের দায় চাপিয়ে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করেন বাগান ম্যানেজার রিংকু চক্রবর্তী। শ্রমিকদের বেতন দেওয়া কিংবা মন্দিরের উন্নয়নের নামে দোকান কোঠা নির্মাণ করার দাবি করেন। কিন্তু আদালত থেকে উচ্ছেদ অভিযানে টিম আসায় দখলের বিষয়টি সামনে তুলে ধরেন বাগান ব্যবস্থাপক।
সরেজমিনে দেখা গেছে, তারাপুর চা বাগানের পাশ ঘেঁষে অনেকেই বসতি নির্মাণ করেছেন। সেই সঙ্গে চা বাগানের লাগুয়া পাকা ঘর দিয়ে দোকান কোটা এমন কী স্থায়ীভাবে ইমারত ও মার্কেট তৈরি করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেবোত্তর সম্পত্তি হওয়ায় তারাপুর চা বাগানের দখল হারান রাগিব আলী। আদালতের রায়ে বাগানের দায়িত্ব পান সেবায়েত পঙ্কজ দাস। রাগির আলী কারাগার থেকে বেরিয়ে আদালতে রিভিউ করার পর পঙ্কজকে বাদ দিয়ে সেবায়েত পরিবারের একজনকে প্রতিনিধি হিসেবে রেখে কমিটি করে দেওয়া হয়।
এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে মন্দির ও চা বাগানের শ্রমিকদের নাম ভাঙিয়ে তারাপুর চা বাগানের টিলা কেটে দোকান কোটা নির্মাণ করে ভাড়া দেন রিংকু চক্রবর্তী। স্থানীয় ৮নং ওয়ার্ডের সাবেক দাপুটে কাউন্সিলর (বর্তমানে পলাতক) জগদীশ দাসকে হাত করে নিজে লাভবান হন রিংকু।
স্থানীয় করেরপাড়া ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় শিমুল ঘোষের কাছে জেএল-৭৬, খতিয়ান-১৭, দাগ নং-৯৭ দাগের ৫০ ফুট ও ২০ ফুটের দোকান কোটা বিক্রি বাবদ ৫ লাখ টাকা নেন ম্যানেজার রিংকু। ২০২৩ সালের ৩০ আগস্ট অগ্রিম টাকা নেওয়া অঙ্গীকার নামায় স্থানীয় কাউন্সিলর জগদীশ দাসকে সাক্ষী রাখা হয়।
গত কয়েকমাস আগে দোকান কোটা বন্ধে এবং অবৈধ সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন এলাকার বাসিন্দারা।
তারাপুর চা বাগানের জমি দখলমুক্ত করতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় বাস্তবায়নের লক্ষে জেলা প্রশাসক কর্তৃক গঠিত ম্যাজিস্ট্রেট ও অপারেশন টিম বুধবার (২৭ নভেম্বর) বিকেলে সরেজমিনে অবৈধ দখলদারের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করেছেন।
এ সময় অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের জন্য নতুনভাবে তালিকা তৈরি করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন- এডিসি রেভিনিউ, সরহকারি কমিশনার ভূমি সদর, সরকারি কমিশনার ভূমি মহানগর, ইউনিয়ন ভূমি সরকারি কর্মকর্তা, ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, জালালাবাদ থানা, এয়ারপোর্ট থানা এবং কোতোয়ালি থানা কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে তারাপুর চা বাগানের ম্যানেজার রিংকু চক্রবর্তী বলেন, তারাপুর চা বাগান সাড়ে ৫০০ একর ভূমি কাগজে কলমে আছে সাড়ে ৩০০ একরের মতো বেদখল আছে। বাগানের অনেক জায়গা দখল ও বিক্রি হয়ে গেছে। বিক্রি করা ওই জমিতে গড়ে উঠছে পাকা ঘর। দখল হওয়া জমি উদ্ধার করতে গেলে অনেক সময় বাধার মুখে পড়তে হয়। তবে জেলা প্রশাসন চা বাগানের জমি দখলমুক্ত উদ্যোগ নিয়েছেন। সে লক্ষে বুধবার বাগান পরিদর্শন করেছেন। অথচ তিনি নিজেই দখলীয় স্বত্ত্বে ভূমি বিক্রি করেছেন, সে কথা অস্বীকার করেন। বরং বাগানের ৫০০ একর জমির মধ্যে ১৩০ একর ধরে রাখতে পেরেছেন বলে জানান।
তিনি বলেন, দেবোত্তর সম্পত্তি বিক্রি করা যায় না, তবে আত্মরক্ষার জন্য আমরা এখানে শ্রমিকদের ঘর বানিয়ে দিই। মেডিকেল কলেজের সামনে ২০টি দোকান আছে। তবে দেবোত্তর সম্পত্তির ওপর স্থাপনা সবই অবৈধ। কাগজে কলমে ৩২৩ দশমিক ৮ একরের মধ্যে ১৩০ একর বাগানের দখলে আছে। নিজে জায়গা বিক্রি করলেও মৌখিকভাবে কাউকে বসান না বলে দাবি করেন তিনি। অথচ তার লিখিত কাগজেই বসতি গড়েছেন অনেকে।
জানা গেছে, ঢিলেঢালা মালিকানার কারণে বিবর্ণ হয়েছে তারাপুর চা বাগান। এতদিন দখলদারিত্বে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের চোখ বাগানের চারদিকে। এখন রক্ষক হয়েও ম্যানেজার নিজেই ভক্ষকের ভূমিকায়।
স্থানীয়দের অভিযোগ চা শ্রমিকদের কল্যাণ ও মন্দিরের নামে বাগানের জায়গা বিক্রি ও টিলা কেটে দোকানকোটা নির্মাণে বাগান ব্যবস্থাপক রিংকু চক্রবর্তী নিজেই সরাসরি জড়িত।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০২৪
এনইউ/জেএইচ